অপরাধ দমন এবং সৃজনশীল কার্যক্রমে কিশোরদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি প্রসঙ্গে

নেছার আহমদ | মঙ্গলবার , ২৭ এপ্রিল, ২০২১ at ৬:৪২ পূর্বাহ্ণ

আধুনিক বিশ্বে প্রযুক্তির উন্নত ব্যবহার জ্ঞান-বিজ্ঞান সহ সকল প্রকার আনন্দ উল্লাসের সামগ্রী আমাদের হাতের মুঠোয়।
সাম্প্রতিক সময়ে খবরের কাগজের সংবাদ বিতর্কিত বক্তা রফিকুল ইসলাম মাদানীর মোবাইল ফোনে আপত্তিকর ও কুরুচিপূর্ণ ‘এডাল্ট কনটেন্ট’ অশ্লীল ভিডিও চিত্র সহ পর্ণোগ্রাফিতে পরিপূর্ণ। যদিওবা রফিকুল ইসলাম মাদানী একজন আলোচিত ইসলামী বক্তা। তাই তার মোবাইলে অশ্লীল ভিডিওর বিষয়টি পত্রিকার খবর হয়েছে। আমাদের সমাজে এখন শিশু কিশোরদের মাঝে প্রত্যেকটি মোবাইলে হয়তো এ ধরনের পর্নোগ্রাফিগুলো পাওয়া যাবে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে জনপ্রিয় অ্যাপ টিকটকের ভিডিও চিত্রে কখনো সোনালি, কখনো বা চকচকে সবুজ চুলের অফু বাই, গোল হয়ে বসে বলছেন, সানি লিওনকে, আবার মেয়ে বন্ধুদেরকে উত্ত্যক্ত করার দায়ে কোনো কিশোরের ঘাড়ে পা তুলে জুতা মুছছেন। কখনো গানের তালে তালে অন্য কোনো টিকটক তারকাদের হুমকি দিচ্ছেন। বর্ণিত বিষয়াদি কোন কাহিনী নয় -এ ঘটনাগুলো হচ্ছে বর্তমান সময়ে আলোচিত কিশোর গ্যাং বিষয়ক কথকতা। প্রথম জানুয়ারি ২০১৭ তারিখে ট্রাস্ট স্কুল এন্ড কলেজের অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র আদনান খুন হওয়ার পর দেশে প্রথম কিশোর গ্যাংয়ের জোরালো অস্তিত্বের খবর পাওয়া যায়।
বর্তমানে এসময়ে দেশে যে বিষয়টি সবচেয়ে আলোচনায় উঠে এসেছে সেটি হলো, নারী বৈষম্যের মাধ্যমে নারীদের যৌন হয়রানি, কিশোরী নির্যাতন সহ ‘কিশোর অপরাধ বা কিশোর গ্যাং’ বিষয়ক কাহিনী।
সংবাদপত্রে এ ধরনের দুয়েকটি সংবাদই সরকারের সফলতাকে ম্লান করে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। জাতিসংঘের সংস্থা ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে কিশোর কিশোরীর সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। কিশোর অপরাধের হারে ২০১২ সালে ৪৮৪টি মামলা হয়েছে ৭৫১ জনকে আসামী করা হয়েছে। ২০২০ সালে এসে জানুয়ারি হতে জুন ছয়মাসের হারে লক্ষ্য করা যায় মামলার সংখ্যা ৮১২ টি, আসামীর সংখ্যা ১১৯১।
কিশোর অপরাধের ধরণ আমরা অতীতে দেখেছি, চুরি ও পকেটমারি। কিন্তু বর্তমানে তা মারাত্মক আকার ধারণ করে হয়েছে মাদক, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মারামারি। এছাড়াও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের আশ্রয়ে এবং প্রশ্রয়ে তৈরী হচ্ছে ‘কিশোর গ্যাং’।
কিশোরেরা কেন অপরাধে জড়াচ্ছে? তা নিয়ে বিস্তর গবেষণা থাকলেও সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর তাতে কোন আগ্রহ পরিলক্ষিত হয় না বা হচ্ছে না। তাই ভালো ভালো আইন ও নীতিমালা প্রণয়ন করা হলেও সে সব আইন ও নীতিমালা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ হতে জানানো হচ্ছে, কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর প্রবণতা কমেনি বরং প্রকোপ ও পরিধি দুই-ই বেড়েছে। এমন কি তারা ‘টিকটক লাইকি’ এর ন্যায় বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন গ্যাং গড়ে তুলছে। ‘টিকটকের’ নায়িকা বানানোর টোপ দিয়ে কিশোরী ধর্ষণের মতো অপরাধের মামলাও হয়েছে। কিশোরেরা জড়িয়ে পড়েছে জঙ্গিবাদেও। ইমপ্লিকেশন অ্যান অ্যানথ্রোপনজিক্যাল স্ট্যাডি শিরোনামে এক গবেষণায় ২০১৭ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাবিনা শারমিন বলেছেন, ‘সমাজ বিজ্ঞান বলছে, পরিবার, সমাজ, ধর্ম ও বন্ধু বান্ধব, কিশোরদের অপরাধ থেকে বিরত রাখতে পারে। একে বলা হয় সামাজিক নিয়ন্ত্রণ। এ নিয়ন্ত্রণ বর্তমানে নষ্ট হয়ে গেছে। আগে কিশোররা প্রকাশ্যে ধূমপান করলে পাড়ার মুরব্বীরা শাসন করতেন। স্কুল কলেজে ছোট ভাইরা কোন অনৈতিক কিছু করতে দেখলে বড় ভাইয়েরা শাসন করছে। এখন পাড়ার মুরব্বীরা এদেরকে দেখে নিজেরাই ভয় পান। অন্যদিকে বড় ভাইয়েরা শাসন করাতো দূরে থাক বরঞ্চ তাদেরকে দিয়ে অনৈতিক কাজ করিয়ে নেয়। এসব কিশোর ও তরুণদেরকে রাজনৈতিক গড ফাদাররা নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য আশ্রয় প্রশ্রয় দিয়ে থাকে। ফলে পাড়ার গুরুজন মুরুব্বীরা পারত পক্ষে এদেরকে এড়িয়ে চলে। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, আমাদের পাড়া প্রতিবেশি চাচা, চাচীরা আমাদের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব পালন করতেন। এতে আমাদের পিতা মাতা বা ভাই বোনেরা কোন সময় বাধা হয়ে দাঁড়াইনি। ফলে সামাজিক বন্ধন ও আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ়তর হয়েছে। ছেলে মেয়েদের মাঝে শ্রদ্ধাবোধ এবং নৈতিকতার শিক্ষা কোনমতেই কমতি হয়নি। বর্তমানে পাড়ার কেউ শাসন করলেই পিতা মাতা ভাই বোনেরাই প্রথম অপরাধীর পক্ষ নিয়ে ঝগড়া শুরু করে। যার কারণে আমাদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়ে গেছে। কেউ কারো বিষয়ে মাথা ঘামায় না। ফলে কিশোর অপরাধ দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রযুক্তি ও বিশ্বায়নের সঙ্গে অভিভাবকেরা অনেক সময় তাল মেলাতে পারছেন না। সন্তান কি করে সময় কাটায়, ডিজিটাল ডিভাইসে কি কি করে তাঁরা বুঝে উঠতে পারেন না।
এ অঞ্চলে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পড়ার কারণ নিয়ে প্রথম ১৯৬০ সালে গবেষণা করা হয়। তখন পুলিশের জন্য ‘স্ট্যাডিজ ইন জুভেলাইন ডেলিনকোয়েন্সি এ্যান্ড ক্রাইম ইন ইস্ট পাকিস্তান’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেন কলেজ অব স্যোশাল ওয়েলফেয়ার রিসার্চ সেন্টারের গবেষক সালাহ উদ্দিন আহমেদ।
পাকিস্তান আমলে কিশোরদের অপরাধে শীর্ষে ছিল, চুরি আর পকেটমার। বর্তমানে তারা ক্রমশ মাদক, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই ও মারামারির ন্যায় অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
সন্তানদের যদি আমরা সত্যিকারভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ মনে করি, তাহলে কঠিন এ সময়ে নিশ্চুপ বসে থাকলে চলবে না। যে অবস্থায় আমরা এখন আছি, একে সামাজিক অবক্ষয়ের বিপজ্জনক পর্যায় বলা যেতে পারে। এত্থেকে আমাদের উত্তরণ ঘটাতে হবে। কিশোরেরা যখন ভয়ানক সব অপরাধে জড়িয়ে পড়ে তখন ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র কেউ মুখ ফিরিয়ে বসে থাকতে পারে না।
পরিবারের মাধ্যমে, স্কুল, কলেজ, পাঠশালায়, সমাজের বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠক এবং ধর্মীয় ব্যবস্থাপনাকে কাজে লাগিয়ে এর প্রতিকার করা এবং সমাধান সম্ভব।
শিশুদের নৈতিকতা শেখানো হবে, ভালো মন্দের পার্থক্য বোঝানো হবে। অতীতে আমরা শিশু বেলায় বাল্য শিক্ষায় প্রতিনিয়ত বিভিন্ন নীতিবাক্য পড়ে এসেছি। বর্তমানে তা শিশুকাল হতে প্রাথমিক পাঠে নতুনভাবে পড়াতে হবে ‘সদা সত্য কথা বলিবে, মিথ্যা কথা মহাপাপ, গুরু জনকে ভক্তি করিবে।’ অতীতের এসব নৈতিকতা সম্পন্ন শিক্ষার স্থলে আজকাল আবোল তাবোল জাতীয় বিষয়ে পড়িয়ে শিশুদের মনোজগতকে অন্য দিকে ধাবিত করা হচ্ছে। নিয়মানুবর্তিতা, বড়দের সম্মান করা, মাদককে না বলার শিক্ষা দেয়া এখন জরুরি। ছেলে মেয়েরা যাতে একে অপরকে সম্মান করতে শেখে, ভিন্ন ধর্ম-বর্ণ মত বর্ণের প্রতি শিশু বয়সেই শ্রদ্ধাশীল হতে পারে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে তা পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
শিক্ষকদেরকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষিত করতে হবে। ক্লাব বিষয়ে এবং ক্লাবের বা বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে তাদেরকে জড়িত করে তাদের অংশগ্রহণ এবং পাঠ্যসূচিতে তা অন্তর্ভুক্তি খুবই জরুরি।
আনন্দজনক ব্যবস্থাপনা, তরুণ ক্রীড়াবিদ, গায়ক, অভিনেতা, আবৃত্তিকার, কবি, সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণে শিক্ষা কার্যক্রমকে প্রাথমিক পর্যায় হতে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সকলের আন্তরিকতা ও বাজেটে প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের সবার সদিচ্ছার প্রয়োজন রয়েছে।
কিশোর অপরাধ প্রতিরোধে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে শিশুদের অপরাধে জড়িয়ে পরার বিষয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। শিশু একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি এবং শিশু মনোতোষ গঠনের কারিগর শিশু সাহিত্যিকরা এবিষয়ে জোরালো ভূমিকা রাখতে পারেন। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা, হেফজখানা, এতিমখানার ন্যায় ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারের নজরদারিতে রেখে শিশুদের মাঝে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক শিল্পকলা বিষয়ে তাদের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। আমরা পরিসংখ্যানে দেখেছি, যে সব শিশু কিশোর নাচ, গান, নৃত্যকলা, শিল্পকলা, লেখালেখি সহ খেলাধুলার মাঝে সম্পৃক্ত রয়েছে তাদের মাঝে অপরাধ প্রবণতা খুবই কম। গবেষণার মাধ্যমে আমাদের জনসংখ্যার ৩ কোটি ৬০ লাখ কিশোর কিশোরীদেরকে অপরাধ মুক্ত করতে পারলে উন্নয়নশীল দেশে কর্মীর ও সুনাগরিকের কোন অভাব হবে না।
মহামনীষীরা বলেছেন, ‘যুবকদের সংশোধন ব্যতিরেকে কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না।’ তরুণ, কিশোর, যুবকরাই হচ্ছে আমাদের জাতির মূল শক্তি। এসব শিশু, কিশোর, যুবকদেরকে প্রাথমিক পর্যায় হতে যদি আমরা নৈতিকতার শিক্ষায় গড়ে তুলতে পারি। স্কুল, ক্লাব বা বিভিন্ন সাংগঠনিক অবকাঠামোর মধ্য দিয়ে মানসিক বিকাশের মাধ্যমে তাদের মনোজগতকে যদি সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা যায় তবে আমাদের যুব শক্তিই পৃথিবীর আধুনিক উন্নত শক্তি হিসেবে গড়ে উঠবে। তাদের মধ্য হতেই নতুন নেতৃত্বের বিকাশ ঘটবে।
সুতরাং আধুনিক উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে সাথে সংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং খেলাধুলা সহ শারীরিক ও মানসিক বিকাশ গঠনের দিকে নজর দিতে হবে বেশি। এতেই হয়তো আমরা ‘কিশোর গ্যাং’ নামক ভয়ানক এ ব্যাধি হতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব।
আইনের কঠোরতায় এসব কিশোরদের অপরাধ প্রবণতা আরো বৃদ্ধি পাবে। সে পথে না গিয়ে সংশোধন ও ভালোবাসার হাত ধরে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে জরুরি পদক্ষেপ নিবেন বলে আমরা আশা করি।
সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেটি হলো পারিবারিক বন্ধন। ঘরের মধ্যেই সংশোধনমূলক ব্যবস্থা। যা প্রাথমিকভাবে পিতা, মাতা, ভাই, বোন, আত্মীয় স্বজন, পরবর্তীতে স্কুল, তবেই আমাদের মাঝে চারিত্রিক যুব শক্তি গড়ে উঠবে। কিশোর গ্যাং নামক ভয়াবহ ব্যাধি হতে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরহম করো আল্লাহ
পরবর্তী নিবন্ধপ্রিয় নেত্রী : চট্টগ্রাম মানেই দেশের ইজ্জত