অপরাধ কী? কাকে বলে? কী করা উচিত নয়। এই বাক্য সেই ছোটকাল থেকেই একজন অভিভাবক তার সন্তানকে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। কোনো অভিভাবক চান না তার আদরের সন্তান অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ুক। সেই ছোটকাল থেকে একজন শিশুকে যেভাবে ন্যায়– অন্যায়, সত্য– মিথ্যা, অপরাধ ও নিরাপদ অর্থাৎ সাদা– কালো চিহ্নিত করে শিক্ষা দেওয়া হয় সেই অনুপাতে সেই শিশুটি কতটুকু অর্জন করতে পারছে তা বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। সঠিকভাবে সেই শিশুটি যদি এই শিক্ষার যথার্থ বুঝতে পারত তাহলে হয়ত সমাজে এত অপরাধের জন্ম হত না। একজন শিশু কখনো অপরাধী হয়ে জন্মগ্রহণ করে না। একজন শিশু কখনো একজন পাপী হয়ে পৃথিবীতে আসে না। হয়ত কারো না কারো পাপের ও অপরাধের ফসল হিসেবে কেউ কেউ এই সুন্দর পৃথিবীর মুখ দেখে, কিন্তু তার জন্মের জন্য সেই শিশু দায়ী নয়। একজন নারী সহজেই অপরাধের সাথে মুক্ত হয় না। নারী তার মাতৃত্বের গুণাবলিতে যতটুকু পারেন অপরাধ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার চেষ্টা করেন। কিন্তু নিষ্ঠুর ও নির্মম বাস্তবতায় নারী কয়েদীদের একটা বিরাট অংশ নিজেকে অপরাধে জড়াতে বাধ্য হয়। অভাবের তাড়নায় অধিকাংসই নিজেকে অপরাধ জগতের দিকে ঠেলে দেয়, লোভ– লালসা ও হিংসার বশবর্তী হয়েও একজন নারী কয়েদীর জন্ম হয় না। বাস্তবতায় তাকে কয়েদী বানিয়েছে। নারী কয়েদীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়ার যে উদ্যোগ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় নিয়েছে, সেটি ‘অভিনয়’ মনে হলেও গুরুত্বের দাবি রাখে। বাংলাদেশের প্রস্তাবটি নতুন। কিন্তু পশ্চিমের অনেক উন্নত দেশে এই সুবিধা দেওয়ার রেওয়াজ আছে। জানা সত্ত্বে, প্রতিবেশী ভারত ও শ্রীলঙ্কাতেও নারী কয়েদীরা বিশেষ সুবিধা পেয়ে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের নারী কয়েদীরা অনেকভাবেই নির্যাতীত। সমাজ ও সংসারের আঘাত প্রতিঘাতে যখন একজন নারীর অবস্থান কারাগারে তখন সেখানেও তারা নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়। কেউ কখনো শখ করে কারাগারে যেতে চায় না। জীবনের এমন কোনো কিছু না পাওয়ার কারণে অথবা অতিরিক্ত লোভের কারণে সাধারণত অপরাধ করে থাকে। অভাবের তাড়নায় এবং সাংসারিক কারণে দরিদ্র মহিলারা অনেক ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে বস্তি এরিয়ার ও স্টেশন রোডে থাকা এক শ্রেণির নিম্ন আয়ের মহিলারাই এই ধরণের অপরাধগুলো করে থাকে। তবে গ্রামগঞ্জের নিম্ন আয়ের মহিলারা তেমন জড়িত না। কিন্তু শহরে অবন্থানরত অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত এই মহিলারাও এক সময় গ্রামেই থাকত। কিন্তু জীবিকার তাগিদে নাড়ির টান ছিড়ে শহরে আসে এরপর হয়ত জীবনের পথ সুগম করতে অন্ধকারে তালিয়ে যায়। তাদের এই পথ বেছে নেওয়ার পিছনে অভাবই মূলত মূল কারণ।
নিম্ন আয়ের মহিলারা যারা এক সময় কয়েদী হয় তার পিছনের ইতিহাস এমনি সত্যিকারের ইতিহাস। মাদক, নারী পাচার, চোরাচালানী, দেহ ব্যবসা ইত্যাদী অপরাধের কারণেই অধিকাংশ নারী গ্রেফতার হয়। তবে কেন তারা সংসারের ও সন্তানের মায়ার বন্ধন ছিড়ে এই অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়ছে তার কারণ চিহ্নিত করতে হবে। কারণ বর্তমান সময়ে পুরুষের পাশাপাশি মহিলারাও অনেক অনেক অপরাধের সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে। এক একটি ঘটনার বিবরণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। যেখানে নারীকে কোমলমতি হিসেবে চিহ্নিত করা হয় সেখানে এমন ঘটনা মেনে নেওয়া কষ্টকর।
শান্তি ভোগ করার পর পুরুষ কয়েদীদের পক্ষে বাড়িতে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়া যতটা সহজ, নারী কয়েদীদের ক্ষেত্রে সেটি অনেক সময়ই সম্ভব হয় না, এমনকী আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাদের গ্রহণ করতে চায় না। তাই আবার অপরাধের সাথে জড়িয়ে যায়। অধিকাংশ পেশার অধিকাংশ জনবল কোন না কোনভাবে অন্যায় ও অসৎ উপায়ে আর্থিক মুনাফা লাভে সচেষ্ট থাকে। তাই যারা সৎ উপায়ে উপার্জন করতে চায় তারা নানাভাবে বাধাগ্রস্থ হতে থাকে। এভাবে বাধাগ্রস্ত হতে হতে এক সময় তারা অন্যায় ও অসৎ উপায়ে জীবিকা নির্বাহের পন্থা গ্রহণ করে। আর এর ফলে সমাজের একটি বিরাট অংশ জুড়ে মহিলারাও এক সময় কোন না কোনভাবে অন্যায় পথে এগোতে থাকে। তবে নিম্ন আয়ের মহিলারাই বেশি, আর যারা মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত তারা লোভ–লালসার বশবর্তী হয়েও অসৎ পন্থাকে বেছে নেই। সমাজে এক শ্রেণি মানুষ আছে যারা অর্থকে মর্যাদা ও প্রতিষ্ঠার মাপকাঠি হিসেবে গণ্য করে। আর তারাই অর্থ ও অন্যান্য জিনিসের জন্য এক সময় অন্যায় পন্থাকে বেছে নেয়। ফলে তেমন অর্থের প্রয়োজন না হলেও এক সময় ন্যায় ও অন্যায় বিভেদ ভুলে যায়। কর্মফল স্বরূপ একসময় তাদেরকে আইনের সম্মুখীন হতে হয়।
আমাদের দেশের কারাগারগুলো কতটুকু নিরাপদ তা বিবেচনায় এনে সরকার প্রসংশামূলক উদ্যোগ নিয়েছে। নারীর নিরাপত্তার জন্য যে আইনী ব্যবস্থা আছে তা যথেষ্ট নয়। দিনে দিনে যে হারে নারী–কয়েদীর সংখ্যা বাড়ছে তাতে যথাযথ ও কার্যকরী পদক্ষেপ নেত্তয়া জরুরি। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা বিধিমালা, ২০১৮ নামে একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করেছে। নারী কয়েদিরা অর্ধেক শাস্তি ভোগ করার পর বাকী–সময় শর্ত সাপেক্ষে বাড়িতে থাকতে পারবেন। তবে বিশেষ সুবিধার আওতায় আসা নারীকে প্রথম দুই মাসে ন্যূনতম ১৫ দিনে একবার এবং পরে শর্তে উল্লেখিত সময়ে পর্যবেক্ষণ করবেন প্রবেশন অফিসার। তিনি মুক্তি পাওয়া নারী কয়েদিকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা দেবেন এবং নথিতে তা লিখে রাখবেন। কয়েদি বাসস্থান পরিবর্তন করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে জানাবেন। কেউ শর্ত ভঙ্গ করলে তার বিশেষ সুবিধাও বাতিল হবে। ২০০৬ সালে পাস হওয়া কারাগারে আটক সাজাপ্রাপ্ত নারীদের বিশেষ সুবিধা আইন, ২০১৬ এর আওতায় তৈরি ঐ বিধিমালা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। পরবর্তী ধাপ হবে আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠকে প্রস্তাবটি চূড়ান্ত করা এবং তা আইনে পরিণত হতে হলে মন্ত্রিসভা ও জাতীয়–সংসদের অনুমোদন প্রয়োজন হবে। আইনি প্রক্রিয়ার দীর্ঘ যাত্রার কথা মনে রেখে ও সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানানো হয়। এই সুবিধার দেওয়ার অন্যতম কারণ কারাগারগুলো এখনো নারী কয়েদিদের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ করা সম্ভব হয়নি। শারীরিক ও মানসিকভাবে নিরাপত্তা বিধান করে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলো কতটুকু কার্যকরী হচ্ছে সেই বিষয়টিকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা প্রয়োজন। কারণ নারী– যখন কয়েদখানায় থাকেন তাকে এক অন্য জগতের মুখোমুখি হতে হয়। কিন্তু পুরুষ কয়েদীকে শুধুমাত্র– শারীরিক শাস্ত্রী ও আর্থিক জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়। অন্য দিকে নারী কয়েদিকে অনেক সময় শারীরিকভাবে নিগৃহীত পর্যন্ত হতে হয়। তাই যারা কয়েদখানায় চাকরি করেন তাদের চারিত্রিক দিকটি একটি বড় চিন্তার বিষয়। এই বিষয়ে নারী কয়েদখানায় নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করলে এই সমস্যা অনেকাংশে কমে যেতে পারে। তবে সূত্র মতে, বাইরে চাকরীরত কয়েদখানার সাথে জড়িত অনেক পুরুষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নারী কয়েদখানায় গিয়ে নারী–কয়েদীকে নানাভাবে নির্যাতন করে থাকেন। নারী কয়েদীরা মায়ের ভূমিকাকে কখনো অস্বীকার করতে পারে না। হয়ত সে কয়েদী কিন্তু তার আসল পরিচয় সে একজন মা। তাই অনেক সময় নারী কয়েদীদেরকে তার শিশু বাচ্চাকে ও সাথে রাখতে হয়। একজন শিশু যখন মায়ের ওপর কোন ধরনের নির্যাতন হতে দেখে তখন কখনো জীবনকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। তাই শুরু থেকে সে জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণ পোষণ করে।
এক পরিসংখ্যান মতে, দেশের মোট নারী– কয়েদির ১ দশমিক ৮ শতাংশ নারী। অনেক সময় নারী কয়েদিদের সঙ্গে তাদের শিশু সন্তানেরা কারাগারে থাকতে বাধ্য হয়। কিন্তু নারী– কয়েদিদের দেখাশুনার জন্য কারাগারে যে সংখ্যক নারী–কর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষী থাকার কথা বাস্তবে তা নেই। ফলে অনেক নারী কয়েদি পুলিশ, জেল কর্মকর্তা ও রক্ষীদের হাতে নিগৃহীত হন। শুধুমাত্র নারী কয়েদী নয়, যে শিশুরা মায়ের সাথে কয়েদখানায় অবস্থান করে তারাও নানাভাবে অত্যাচারিত হয়। তাই চার দেওয়ালের ভিতরের এই নিষ্ঠুর পরিবেশকে সে বাইরের পরিবেশের সাথে মেলাতে পারে না। এভাবে এক সময় সেই শিশুটি মানসিকভাবে অপরাধ জগতে বিচরণ করতে থাকে। ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায় এক সময় সেই কোমলমতি শিশুটি নিজেকে অপরাধে জড়িয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। নারী– কয়েদীদের জীবিকার বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় আনা জরুরি কারণ কারাবাসের পর একজন নারীকয়েদী কীভাবে জীবন যাপন করবে এই বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে ভাবতে হবে। কারণ কারাবাসের পর যখন সে নতুন করে বাঁচতে চেষ্টা করে তখন তাদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তাদের চলার পথকে সুগম করতে তাদের পূনর্বাসনের জন্য যা কিছু করা দরকার তার ব্যবস্থা করতে হবে। অনেক সময় মন্ত্রণালয়গুলো জনস্বার্থে অনেক ভালো প্রস্তাব দিলেও সেগুলো শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না। আমলাতান্ত্রিক জঠিলতা ও স্বার্থন্বেষী মহলের অসহযোগিতায় মাঝপথে আটকে যায়। আমাদের দেশে শুধু একটির পর একটি আইন তৈরী হতে দেখা যায়। কিন্তু সময়োপযোগী ও কার্যকরী আইনগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে দিতে অনেক সময় সেই আইনটি অকার্যকর হয়ে পড়ে। যারা আইন প্রণেতা তাদেরকে অনেক বেশি সচেষ্ট হওয়া উচিত। কারণ আইন শুধু কাগজে কলমে না থেকে বাস্তব ও বাস্তবতার সাথে মিল রেখে তা কার্যকরী করার দায়িত্ব আইন প্রণেতাদের। তাই অপরাধীদের ঘৃণা করা নয়, বরং অপরাধ দমনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ ডাঃ ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম।