বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। বৃহস্পতিবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য নিশ্চিত করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে আয়োজিত দুই ঘণ্টাব্যাপী এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রেস সচিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারকে সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ লক্ষ্যে নীতিগত কাঠামো ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণে একটি কমিটি গঠন করা হচ্ছে।
এই কমিটির নেতৃত্ব দেবেন শিক্ষা উপদেষ্টা সিআর আবরার। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন– আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান, সড়ক পরিবহণ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান। এ কমিটি রাজনৈতিক দলের আদর্শগত উদ্দেশ্য পূরণে অতীতে কোনো টেলিভিশন চ্যানেলকে লাইসেন্স দেওয়া হয়ে থাকলে তা তদন্ত করার পাশাপাশি, ভবিষ্যতে নতুন লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রেও একটি নীতিমালা প্রণয়ন করবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ও বাংলাদেশ বেতারের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকায় ক্রমেই জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। হারানো গৌরব ফিরে পেতে হলে প্রতিষ্ঠান দুটির সমন্বয়ে সমপ্রচার কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে। নয়তো সরকারের নির্দেশনায় অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার চলতে থাকবে।
এ প্রসঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেন দেশবাসী। তাঁরা মনে করেন, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন যতদিন সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, ততদিন সরকারের নির্দেশনায় অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার করতে হবে। কোনো কোনো সময় স্থানীয় এমপিদের সংবাদ প্রচার না করলে তারা উষ্মা প্রকাশ করতেন। তাঁরা বলেন, বেতার কি এখনও আছে বা চলে, এটা সাধারণ শ্রোতার প্রশ্ন। নীতিনির্ধারক এবং সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষও এই প্রশ্ন করে থাকেন।
এখানে উল্লেখ্য, ২০০৯ সালে বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসনের জন্য গঠিত কমিটি এ পর্যন্ত কী কী কাজ করেছে তা জানাতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিল হাইকোর্ট। তৎকালীন বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ ও বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর বেঞ্চ মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’ এর রিট আবেদনের শুনানির সময় এই আদেশ দেয়। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রথাগতভাবে ক্ষমতাসীন সরকারের প্রচারযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় এদের স্বায়ত্তশাসন একটি বহুল আলোচিত বিষয়। বেতার–টিভির স্বায়ত্তশাসনের জন্য তৎকালীন সচিব মোহাম্মদ আসাফ্উদ্দৌলাহ ১৯৯৭ সালের ৩০ জুন কিছু সুপারিশ পেশ করেন। সেই সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য অধিকার ২০০০ সালে জনস্বার্থ রিট আবেদনটি দায়ের করে। রিট আবেদনটির ওপর চূড়ান্ত শুনানির সময় সরকার পক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজরুল ইসলাম তালুকদার আদালতে বলেন, ১৯৯৯ সালের ২৫ মে এ বিষয়ে আরো একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটির কাজ চলছে। তখন আবেদনকারীর পক্ষে অ্যাডভোকেট আদিলুর রহমান খান বলেন, এই দশ বছরে ওই কমিটি কী কাজ করেছে তা আদালতের জানা দরকার। এ বিষয়ে আদালত নির্দেশ দিতে পারে।
১৯৯০ এর শেষে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের অবসানের পর তার বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলো বেতার টিভির স্বায়ত্তশাসনের ব্যাপারে একমত হয়। কিন্তু পরবর্তী বিভিন্ন সরকার এ নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এলেও এ ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে সামান্যই। পর্যবেক্ষকরা এজন্য ক্ষমতাসীন দলগুলোর সদিচ্ছার অভাবকেই দায়ী করে থাকেন।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিটিভি চট্টগ্রাম স্বেচ্ছাচারিতার দিক দিয়ে এক কদম এগিয়ে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বকালেও কতিপয় রাজনৈতিক নেতার নির্দেশে টিভি চলছে। জানা গেছে, ওদের চাপে পড়ে তালিকাভুক্ত শিল্পীদের কোনো প্রোগ্রাম দিতে পারছে না টিভি কর্তৃপক্ষ। শিল্পীদের কোনো দল নেই। তাঁরা সব দলের সব মানুষের। তাঁরা কেন টিভির নিয়মিত অনুষ্ঠান প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। তালিকাভুক্ত অনেক গ্রন্থনাকারী ও উপস্থাপককে টিভি কর্তৃপক্ষ ডাকে না। ফলে তাদের অনুপস্থিতিতে নিজের কিছু মানুষকে নানা প্ররোচনায় উপস্থাপনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তালিকাভুক্ত বঞ্চিত উপস্থাপক–শিল্পীরা আদালতের আশ্রয় নেবেন বলে খবর পাওয়া গেছে। তাঁদের উপস্থিতি থাকলে হয়তো উদ্দেশ্যমূলকভাবে সুযোগ দেওয়া শিল্পীদের এটা বড় দাগে চোখে পড়তো না। এ জন্য বেতার–টিভির স্বায়ত্তশাসন অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্তকে আমরা অভিনন্দন জানাই।