অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা-ভাবনা

ছন্দা চক্রবর্তী | বুধবার , ২ জুলাই, ২০২৫ at ৬:৫৪ পূর্বাহ্ণ

অন্তর্র্বর্তী সরকারের শিক্ষাভাবনার গুটি গুটি পদক্ষেপের অগ্রগতি। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার পরতে পরতে সমস্যা। সব সরকারের শুরুতে আপামর জনসাধারণের ভাবনা জাগে, এবার হয়তো শিক্ষা ব্যবস্থায় একটা আমূল পরিবর্তন আসবে, যা প্রযুক্তি জগতের অভাবনীয় জ্ঞানকে আয়ত্বে আনার মতো কৌশলী, আধুনিক মানসম্মত শিক্ষা কারিকুলামসহ শিক্ষার সর্বস্তরে শিক্ষা কার্যক্রমের কার্যকরী ব্যবস্থা চালু হওয়ার সুযোগ ঘটবে। কিন্তু কিছু দিন পরই মানুষের সেই ধারণার বিসর্জন হয়। দলীয় সরকার এর আমলে যেমন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে আলগা ভাব বা আই ওয়াশ পদ্ধতি চলছিলো ঠিক তেমনটিও নয়, আরো গুরুত্বহীনভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার অধ:পতন এজাতির নির্বিকার ভাবে দেখে যাওয়া ছাড়া যেন আর কিছু করার নেই।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার বদলেও তেমন পজেটিভ পরিবর্তন সাধারণ এর দৃষ্টিতে পড়ে নি। দেশে বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য ১১টি কমিশন হলেও শিক্ষা সংস্কার বলে অন্তর্র্বর্তী সরকারের কোনো কমিটিও নেই। কোনো কোনো সময় প্রতিবাদী ঘটনার প্রতিক্রিয়া হিসেবে শিক্ষাবিদদের পরামর্শ গ্রহণ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংকট নিরসনের সামগ্রিক পরিকল্পনা এখনো সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রক্রিয়াধীন। মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থার ২০১২ সালের ব্যর্থ সৃজনশীল শিক্ষাক্রম এখন চলমান। তবে আশার কথা হলো দুই/একদিন আগে শিক্ষা কারিকুলাম এর পরিবর্তন প্রয়োজন বলে বর্তমান উপদেষ্টা অধ্যাপক চৌধুরী রফিকুল আবরার সম্মতি প্রকাশ করেছেন যা পত্রিকায় উঠে এসেছে। বিভিন্ন গণ্যমান্য শিক্ষাবিদ যেমন ইমেরিটাস অধ্যাপক, অধ্যাপক মনজুর আহমদ, গবেষক ড.নাদিম মাহমুদ উনাদের সাক্ষাৎকার এবং লিখিত কলামে বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার হতাশ চিত্র ফুটে উঠেছে, কিন্তু কেন এমন হবে! যে কোনো জাতির উন্নয়ন তো শিক্ষার উন্নয়ন এর উপরই নির্ভর করে। অথচ বাংলাদেশে শিক্ষার উন্নয়ন বিষয়ক পরিকল্পনার শামুক গতি যেন ভবিতব্য হয়ে পড়ে আছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে আইন উপদেষ্টা, পরিকল্পনা উপদেষ্টা, শিক্ষা উপদেষ্টা, সহ আরও কয়েক জন উপদেষ্টা শিক্ষক হয়েও শিক্ষা নিয়ে ধীর গতির ব্যবস্থাপনা পরিলক্ষিত হয়।

শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সম্পর্কে এখনো ভীতিকর সম্পর্ক বিদ্যমান। শিক্ষার উপর কলঙ্ক দাগ নামক মরচে পড়া সংস্কৃতিগুলি কীভাবে বিলুপ্ত করা যাবে সেটা ভেবেই শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার হাতে নেওয়া প্রয়োজন বলে শিক্ষাবিদদের অভিমত।

সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো ২৪ শে ছাত্রজনতা তথা শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন হলো, কিন্তু শিক্ষার অধোগতি ঠেকানো গেল না। বিখ্যাত শিক্ষাবিদ, লেখক ও সমাজ চিন্তাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী স্যার তাঁর সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শিক্ষাক্ষেত্রের উন্নয়নের প্রাথমিক শর্ত হচ্ছেমাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষার ব্যবস্থা করা, দ্বিতীয় শর্ত হলো, —মেধাবী ও অঙ্গীকারবদ্ধ মানুষদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দান। সর্বোপরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া, যেটা হচ্ছে না : এখন জ্ঞানের নয়, রাজত্ব চলছে টাকার।’ তবে সম্প্রতি পত্রিকার সংবাদ হতে জানা যায় জাতীয় শিক্ষাক্রম সমন্বয় কমিটির সভায়, শিক্ষা কারিকুলাম এর যুগোপযোগী উন্নয়ন এর জন্য এবং শিক্ষার্থীর শিখন অভিজ্ঞতা আনন্দময় ও সহজ করার লক্ষ্যে শিখন শেখানো কার্যাবলী, মূল্যায়ন ও বিষয়বস্তু নির্বাচনেও বিশেষ পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এ উপলক্ষে ২০২১ সালের প্রণীত ( জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রাথমিক স্তর) পরিমার্জন করা হয়েছে। এতে বেশ কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। সবচেয়ে বড় পরিবর্তন এসেছে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায়। সম্প্রতি প্রাথমিকের পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম প্রকাশ করেছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড ( এনসিটিবি)। অনুমোদিত পরিমার্জিত শিক্ষাক্রমটির নামকরণ হয়েছে—‘জাতীয় শিক্ষাক্রম২০২১: প্রাথমিক স্তর (পরিমার্জিত ২০২৫)। এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, জাতীয় মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জীবন দর্শনের প্রতিফলনে নতুন দিক উন্মোচনে এ শিক্ষাক্রম পর্যালোচনা করে পরিমার্জন করা হয়েছে ‘জাতীয় শিক্ষাক্রম ২০২১ (প্রাথমিক স্তর)। তবু্‌ও আশ্বস্ত হওয়ার বিষয় এই যে, ব্যর্থ সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের ব্যবহার থেকে শিক্ষার্থীদের পরিত্রাণ হবে।

এনসিটিবির কর্মকর্তাদের অভিমত হলো, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, শিখন বিশেষজ্ঞ, বিষয় বিশেষজ্ঞ, শ্রেণি শিক্ষক এবং অন্যান্য সুধীজনদের কাছ থেকে যৌক্তিক পরামর্শ ও নির্দেশনা নিয়ে তা পরিমার্জনের পরবর্তী ধাপে যাবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আপাতত পরিমার্জিত এ শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থী কেন্দ্রীক শিখনের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিখন প্রক্রিয়ায় শিক্ষার্থীর সক্রিয় অংশগ্রহণ শিক্ষার্থীদের কৌতুহলী ও অনুসন্ধিৎসু করে তোলার প্রক্রিয়ার কথা মাথায় রেখে পরিমার্জন করা হচ্ছে। এ ছাড়া শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন উত্থাপন ও সমস্যা সমাধানের সুযোগ করে দিয়ে, সর্বোপরি কল্পনা ও উদ্ভাবনী চিন্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে উচ্চতর দক্ষতা অর্জনে ব্রতী করে তুলতে প্রয়োজনীয় সুযোগ রাখা হয়েছে এ শিক্ষাক্রমে। মূল্যায়ন কৌশলে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছে। প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শতভাগ ধারাবাহিক মূল্যায়ন করা হবে, আর তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ধারাবাহিক মূল্যায়নের সংগে সামষ্টিক মূল্যায়ন পদ্ধতি নির্ধারণ করা হবে।

২০২৭ সাল থেকে মাধ্যমিকে চালু হচ্ছে নতুন শিক্ষাক্রম। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রবিউল কবির চৌধুরী বলেন, ‘এ বছর যারা নবম শ্রেণিতে, তারা ২০২৭ সালে গিয়ে পাবলিক পরীক্ষা দিবে, ফলে ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম ২০২৬ সাল পর্যন্ত অটোমেটিক যাচ্ছে। ২০২৭ সালকে টার্গেট করে নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য অভ্যন্তরীণ কাজ শুরু হয়েছে। অংশীজনদের সাথে আলোচনা করেই মূল্যায়ন সহ কারিকুলামের নানা দিক চূড়ান্ত করা হবে। ‘এরই মধ্যে যুগোপযোগী কারিকুলাম প্রবর্তনে প্রারম্ভিক পর্যালোচনা শুরু করেছে এনসিটিবি। ২০২৭ সালে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম, এর পর পর্যায়ক্রমে একটি করে ক্লাসে চালু হবে নতুন শিক্ষাক্রম।

সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এস এস সি পরীক্ষায় দেখা গেছে যে উল্লেখযোগ্য হারে শিক্ষার্থীর অনুপস্থিতি। প্রথম আলো পত্রিকার সম্পাদকীয় তে উঠে এসেছে এই অনুপস্থিতির কারণ হলো আর্থিক অসচ্ছলতা, বাল্যবিবাহ এবং অন্য কোনো সামাজিক প্রতিবন্ধকতা। এসব প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণের উপায়ও শিক্ষার উন্নয়নের অন্তরায়। শিক্ষার এসব প্রতিবন্ধকতা কাটাতে সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন। আর কার্যকরী পদক্ষেপের বাস্তবায়নে আর্থিক বাজেট এর উপর বর্তায়। কিন্তু এক্ষেত্রে সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনার দিকে তাকালে দেখা যায়, সরকারের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাকে কাটছাঁটের বাজেট গ্রুপে ফেলেছে। সাধারণত শিক্ষার মান বাড়াতে গেলে শিক্ষায় বাজেট বাড়ানো হবে এটাই স্বাভাবিক, কিন্তু দেখা গেল শিক্ষার বাজেট আরো কমিয়ে দিয়েছে, সুতরাং শিক্ষার উন্নয়ন জনিত কার্যক্রম ও বাধাগ্রস্ত হবে এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক মনজুর আহমদ স্যার বিশেষ সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘শিক্ষার সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শিক্ষাকে দেখতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকে ভিত্তি তৈরি না করলে কলেজ ও উচ্চশিক্ষায় ভালো করা যাবে না। প্রাথমিকে কিছুটা প্রসার হলেও মানের দিক ও সমতার দিকে তেমন নজর নেই। মাধ্যমিক স্তর আরো অবহেলিত। বিদ্যালয় শিক্ষা হলো ভিত্তি। এখানে ভালো করতে হবে। না হলে অন্য স্তরে ভালো করা যাবে না’। বর্তমান আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের বিশ্ব প্রতিযোগিতায় টিকিয়ে রাখতে হলে, উদ্যোক্তা, উদ্ভাবক ও ডিজিটাল ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তুলতে হলে গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিয়ে বর্তমান সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতেই হবে। অন্যথা শিক্ষা ব্যবস্থার অনিবার্য পতন দেশের জন্য মঙ্গলজনক পরিবেশ তৈরির অন্তরায় হয়ে উঠবে। আমাদেরকেই ভাবতে হবে কীভাবে গুটি গুটি পদক্ষেপের সমন্বয়ে আমাদের মুখস্থ নির্ভর পাঠ্যক্রম, কঠোর মূল্যায়ন কাঠামো ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষার অভাব জনিত বাধাগুলো কাটিয়ে একটি একীভূত উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা যায়।

লেখক: প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, হুলাইন ছলেহনূর কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধকাল থেকে শ্যামল মাওলার থ্রিলার