২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। এবারের বাজেটের সম্ভাব্য আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা। এ হিসেবে গত অর্থবছরের চেয়ে বাজেটের আকার কমেছে প্রায় ৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটের আকার ছিল ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা। পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, এবারের বাজেটে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বা এডিপি ধরা হয়েছে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটিও গত বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে কম। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটে এডিপি ছিল ২ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। এবার রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) জোগান দেবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা, যা মোট লক্ষ্যমাত্রার ৮৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। এছাড়া অন্যান্য খাত থেকে আসবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট লক্ষ্যমাত্রার ১১ দশমিক ৫৩ শতাংশ। বাজেট ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ ভাগ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বা মোট ঘাটতির ৫৫ দশমিক ৩ শতাংশ। আর বিদেশি ঋণ থেকে আসবে ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বা ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ। গতবারের মতো এবারও কালোটাকা সাদা করা করার সুযোগ থাকছে। এছাড়া, অপ্রদর্শিত অর্থ প্রতিরোধে, প্রকৃত মূল্যে রেজিস্ট্রেশন নিশ্চিতে করহার এলাকাভেদে ৮, ৬ ও ৪ শতাংশের পরিবর্তে কমে হচ্ছে যথাক্রমে ৬, ৪ ও ৩ শতাংশ।
এবারের বাজেটে জিডিপির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪–২৫ অর্থবছর জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে অর্জিত হয়েছে ৩ দশমিক ৯৭ ভাগ। এবারের বাজেটে মূল্যস্ফীতি কমানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। এ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের বাজেটেও সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। গত এপ্রিলের হিসেবে দেশের বর্তমান সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ।
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে। প্রস্তাবিত বাজেটের মৌলিক জায়গায় গলদ রয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট আগের সরকারেরই ধারাবাহিকতা। রাজস্ব আয়ের সঙ্গে বাজেটের আকারের সম্পৃক্ততা রেখে বাজেট করা উচিত ছিল, যা করা হয়নি। সেইসঙ্গে, বাজেটের আকার আরও ছোট হওয়া উচিত ছিল উল্লেখ করে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য এই বাজেট বাস্তবায়ন কঠিন হবে। আমির খসরু বলেন, ‘আগের বাজেট যেভাবে চলে আসছে, সেখান থেকে সংখ্যার তারতম্য হয়েছে কিন্তু বাজেটের প্রিন্সিপাল একই রয়ে গেছে। এটাও গতানুগতিক বাজেট। বিগত সরকারের ধারাবাহিকতা থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বের হতে পারেনি। রাজস্ব আয়ের ওপর ভিত্তি করে বাজেট করা উচিত। তাহলে প্রাইভেট সেক্টরে টাকার সরবরাহ থাকবে, বিনিয়োগ থাকবে, ইন্টারেস্ট কমে আসতো, বিদেশি ঋণের পরিমাণ কমে আসতো ও সুদের হারও কম পেমেন্ট করতে হতো। কিন্তু আমরা সেই জায়গা থেকে সরে আসতে পারিনি। আমি মনে করি, এই মৌলিক জায়গায় গলদ রয়ে গেছে।’
অন্যদিকে, প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্তকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। অন্তর্বর্তী সরকারের এ উদ্যোগের কড়া সমালোচনা করেছে সংস্থাটি। টিআইবি একে অনৈতিক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি উল্লেখ করে বলেছে, রাষ্ট্রীয় সংস্কার, বিশেষ করে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারের মূল উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী অবস্থান নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘সবচেয়ে আশঙ্কা ও হতাশার ব্যাপার হলো, সরকারের এই সিদ্ধান্ত দুর্নীতিকে উৎসাহ দেবে।’
২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেটে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও এফআইসিসিআই বেশ কয়েকটি বিষয় নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এসব বিষয় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধিকে ব্যাহত করতে পারে এবং সৎ ও নিয়ম মেনে চলা করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছে সংগঠনটি। বাজেটের ওপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে এক বিবৃতিতে বলা হয়, এফআইসিসিআইয়ের পক্ষ থেকে অর্থ অধ্যাদেশ ২০২৫ খতিয়ে দেখা হয়েছে। বাজেটের কিছু ইতিবাচক দিককে স্বাগত জানালেও বেশ কয়েকটি বিধান নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, যেগুলো ব্যবসার প্রসারকে ব্যাহত করতে পারে এবং সৎ করদাতাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি বলেছেন, প্রস্তাবিত ২০২৫–২৬ অর্থবছরের বাজেট সার্বিকভাবে ব্যবসা ও বিনিয়োগবান্ধব হয়নি। কারণ, প্রস্তাবিত বাজেটে বিনিয়োগ সমপ্রসারণ, ব্যবসার পরিবেশ উন্নয়ন, সিএমএসএমই ও ব্যাংকিং খাত সংস্কারে সুনির্দিষ্ট কোনো দিকনির্দেশনা নেই।
অন্যদিকে, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫–২৬ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার জাতীয় বাজেটকে কিছুটা ‘ব্যতিক্রমী’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশের ইতিহাসে এটিই প্রথমবারের মতো নতুন বাজেট, যা আগের বাজেটের তুলনায় ছোট। তিনি বলেন, প্রবৃদ্ধি–কেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে তারা সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণার উপর জোর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা ঐতিহ্যবাহী ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নকে তুলে ধরার পরিবর্তে এই অর্থ–বছরের বাজেটে জনগণকে অগ্রাধিকার দিয়েছি।’ এসব বিবেচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই বছরের বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সুশাসন, নাগরিক সুযোগ–সুবিধা, কর্মসংস্থান ইত্যাদির উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
নানামুখী আলোচনা–সমালোচনার পরও বলা যায়, প্রস্তাবিত বাজেটে ইতিবাচক বহু দিক রয়েছে। তবু অর্থনীতিবিদদের মতে, এ বাজেট বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ আছে।