অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি বিএনপির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে আমরা তো সকলেই সমর্থন দিচ্ছি। কারণ এই পরিবর্তনে যেসব মৌলিক কাঠামো ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে গেছে সেগুলোকে তো একটা ট্র্যাকে আনতে হবে। সুতরাং আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং আশা করি সামনের কাজগুলো যত দ্রুত সম্ভব তারা করতে পারবে। গতকাল রোববার বিকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের দেখতে গেলে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। এর আগে সকালে তিনি দলের নেতাকর্মীদের বলেন, সুযোগ–সুবিধা নেওয়ার জন্য অনেকেই বিএনপিতে আসার চেষ্টা করছে। তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। দুপুরে আমীর খসরু নগরীর প্রবর্তক মোড়ে ইসকন মন্দির পরিদর্শন করেন। ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষের সাথে কথা বলে সার্বিক অবস্থার খোঁজখবর নেন। পরে তিনি আসকার দিঘির পাড়স্থ রামকৃষ্ণ মন্দির পরিদর্শন করেন।
চমেকে যা বললেন : আমীর খসরু চমেক হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে গিয়ে ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সঙ্গে কথা বলেন এবং তাদের পরিবারের খোঁজখবর নেন। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, আন্দোলনে ছাত্র–জনতার ওপর নির্বিচারে যেভাবে গুলি করা হয়েছে তা অত্যন্ত অমানবিক ও বেদনাদায়ক। তারা (গুলিবিদ্ধ) যে এখনো বেঁচে আছে সেটাই তো আশ্চর্যের ব্যাপার। অনেকের অবস্থা এখনো অনেক ক্রিটিক্যাল, কঠিন সময় যাচ্ছে ওদের। তাদের পরিবারের সব কাজ–কর্ম বন্ধ। ওরা তো সবাই এখন বিচারের অপেক্ষায় আছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ধরনের নির্বিচারে গুলি করে হত্যাকাণ্ড চলেছে বলে আমার মনে হয় না। এই আহত লোকগুলো যে এখনো বেঁচে আছে সেটা আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছুই না। এদের বাকি জীবন কীভাবে কাটবে এটাও একটা বিষয়। আমার মনে হয় তাদের অনেকে ভালো করে হাঁটাচলা করতে পারবে না। অনেকে স্বাভাবিক জীবনযাপনও করতে পারবে না।
আমীর খসরু প্রশ্ন রেখে বলেন, এদের (আহতদের) দায়িত্ব এখন কে নেবে? অনেকে অন্ধ হয়ে গেছে, অনেকের পা চলে গেছে। আবার অনেকের পা থাকলেও সেটি অবশ হয়ে গেছে। তারা হাঁটাচলা করতে পারবে না। এমন দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্ত করতে হলে এদের পুনর্বাসনের ব্যাপার আছে। আর জাতিরও তো পুনর্বাসনের ব্যাপার আছে, যে অবস্থায় আমরা গিয়ে পৌঁছেছি। এ রকম কিছু আমরা কোনোদিন দেখিনি। এত প্রাণ এবং ত্যাগের বিনিময়ে যদি বাংলাদেশ সামনের দিকে এগুতে পারে তবেই আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ দেখতে পাব।
ইসকন মন্দিরে খসরু : ইসকন মন্দির ও রাধাকৃষ্ণ মন্দির পরিদর্শন শেষে আমীর খসরু বলেন, বাংলাদেশের সীমান্তের মধ্যে যারা বসবাস করে তাদের সবাইকে সমানভাবে দেখতে হবে। এটা নিশ্চিত করা শুধু রাষ্ট্রের দায়িত্ব নয়। যারা রাজনীতি করে, সমাজনীতি করে, সকলের দায়িত্ব, সকল ধর্মের।
তিনি বলেন, বেগম খালেদা জিয়া আমাদেরকে পরিষ্কারভাবে বলেছেন, বিএনপি সংখ্যালঘু বলে কোনো শব্দে বিশ্বাস করে না। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান সবাইকে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের সংবিধান প্রত্যেকটা নাগরিককে ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার দিয়েছে। আমি এখান থেকে বলব চট্টগ্রামে যদি কোনো হিন্দু মন্দিরে আক্রমণ হয়, এটার দায় আমাদেরকে নিতে হবে। এই দায় কিন্তু এড়ানো যাবে না।
তিনি বলেন, আমার জানা মতে চট্টগ্রাম শহরে কোনো মন্দিরে হামলা বা আক্রমণ হয়নি। আমি ঢাকা থেকে আমাদের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছি সবসময়। মন্দিরের বিষয়ে আমি খোঁজখবর নিয়েছি। কমিটিও করা হয়েছে। তারা আমাকে ছবিও পাঠিয়েছে। আমি সেখান থেকে মনিটরিং করেছি।
আমীর খসরু বলেন, পরিচয়ের রাজনীতি আমরা করি না। আমাদের সবার পরিচয় হচ্ছে আমরা বাংলাদেশি। পরিচয় দিয়ে কোনো রাজনীতি হয় না। অন্য পরিচয় এনে যদি বাংলাদেশের রাজনীতি করতে হয়, তাহলে যে পরিচয় এনে রাজনীতি করবে তাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে। এটা আমাদেরকে বুঝতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের ভ্রাতৃত্ববোধ, সাম্প্রদায়িক চেতনা, আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ভাবনা, সম্প্রীতি, পরস্পর সম্মানবোধ, সেখান থেকে সরে যাওয়ার সুযোগ নাই এবং সেই যুক্তির উপরে একটা স্বৈরাচারকে বিদায় করেছে। সে সবকিছু ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। সেই ভাবনা ও আকাঙ্ক্ষা থেকে মানুষ স্বৈরাচার, দুর্নীতিবাজকে বিতাড়িত করেছে।
তিনি বলেন, পরিচয়ের রাজনীতির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে খারাপ একটা চিত্র তৈরি করা হয়েছে সেখান থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। আপনাদেরকে ব্যবহার করে রাজনীতির যে একটা চিত্র তুলে দেওয়া হয় সেটা তো ক্ষতিকর, লাভের কিছু হয় না।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম কিন্তু দুনিয়াদারি বুঝে এবং জানে। সবার হাতে হাতে এখন একটা করে মোবাইল ফোন রয়েছে। সবাই সারা দুনিয়া দেখছে এখন। এর মধ্যে আমি এখানে বক্তব্য রাখছি একই সময়ে দুনিয়াতে আরও ৫০–১০০টা বক্তব্য চলছে। আমার বক্তব্য ভালো না লাগলে দুই মিনিট পর সুইচ অফ করে আরেক দিকে চলে যাবে। মানুষকে আর বোকা বানানোর সময় নাই। সবকিছু বিশ্ব দেখেছে।
তিনি বলেন, খারাপ–ভালো বিবেচনা করার যোগ্যতা আমাদের নতুন প্রজন্মের রয়েছে। যারা প্রাণ দিয়ে স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে, আরো কিছুদিন থাকলে ৫০০ থেকে এক হাজার জন আরও মারা যেত। কিন্তু কেউ সরে দাঁড়াবে না। এর আগে গত ১৭ বছর এখানে যারা আছে সবার বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা রয়েছে। ৬০ লাখের উপরে মিথ্যা মামলা হয়েছে।
আমীর খসরু বলেন, ভোট ও নির্বাচন এগুলো মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখানে আমাদের কোনো বিষয় নেই, এটা যার যার নিজস্ব চিন্তা। কিন্তু সেটাকে যদি রাজনীতিকরণ করে একটা গোষ্ঠীকে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়, তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। কিন্তু এটি যারা করে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তারা তো নাই, অনেকে পালিয়ে গিয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে এই বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহবুবের রহমান শামীম, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেন, সহ–সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হাশেম বক্কর, নগর বিএনপির আহ্বায়ক এরশাদ উল্লাহ, দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সুফিয়ান, নগর বিএনপির সদস্য সচিব নাজিমুর রহমান, ইসকন প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের অধ্যক্ষ লীলারাজ গৌর দাস ব্রহ্মচারী, পুন্ডরীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী, চট্টগ্রাম রামকৃষ্ণ মিশন ও মঠের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ স্বামী শক্তিনাথানন্দজী, বিপ্লব পার্থ, রামকৃষ্ণ মিশনের সহসভাপতি তাপস হোড়, প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক দারুব্রহ্ম জগন্নাথ দাস ব্রহ্মচারী, মহানগর বিএনপি নেতা এম এ আজিজ, এস এম সাইফুল আলম, শফিকুর রহমান স্বপন, ইয়াছিন চৌধুরী লিটন, শাহ আলম, আবদুল মান্নান, জয়নাল আবেদীন জিয়া, এড. মফিজুল হক ভুঁইয়া, আবুল হাশেম, আনোয়ার হোসেন লিপু, মন্জুর আলম চৌধুরী মন্জু, মো. কামরুল ইসলাম, মহানগর যুবদলের সভাপতি মোশাররফ হোসেন দিপ্তী, সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ডা. খুরশীদ জামিল চৌধুরী, মেডিকেল কলেজ ড্যাবের সভাপতি অধ্যাপক ডা. জসীম উদ্দীন, জেলা ড্যাবের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ডা. তমিজ উদ্দিন আহমেদ মানিক, সাধারণ সম্পাদক ডা. বেলায়েত হোসেন ঢালী, ড্যাবের কেন্দ্রীয় নেতা ডা. এস এম সারোয়ার আলম, প্রবর্তক শ্রীকৃষ্ণ মন্দিরের সদস্য স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস ব্রহ্মচারী, উজ্জ্বল নীলাম্বর দাস ব্রহ্মচারী, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রীস্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক রাজীব ধর তমাল, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার আহ্বায়ক অধ্যাপক ঝুন্টু কুমার বড়ুয়া, সদস্য সচিব বাপ্পী দে, যুগ্ম আহ্বায়ক সুজন দাশ, সদস্য সুমন ঘোষ বাদশা প্রমুখ।
নেতাকর্মীদের উদ্দেশে খসরু : সকালে মেহেদীবাগের বাসার সামনে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে আমীর খসরু বলেন, আওয়ামী লীগ যে কাজগুলো করেছে এগুলো করা যাবে না। চাঁদাবাজি করা যাবে না। আওয়ামী লীগের সাথে বন্ধুত্ব করে ভাগ বাটোয়ারা করা যাবে না। আওয়ামী লীগের সাথে হাত মিলানো যাবে না। এখন রাজনীতি হবে আদর্শের রাজনীতি। রাজনৈতিক আদর্শকে মানতে হবে, জনগণের সাথে সম্পর্ক বাড়াতে হবে। জনগণের পাশে থাকতে হবে। তাহলে আমাদের এই নতুন স্বাধীনতা সফলতা লাভ করবে।
তিনি বলেন, ধৈর্য ধরে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কোনো প্রকার গ্রুপিং করা চলবে না। এখন সুযোগ–সুবিধা নেওয়ার জন্য অনেকেই বিএনপিতে আসার চেষ্টা করছে। তাদের ব্যাপারে সাবধান থাকতে হবে। হিন্দু–বৌদ্ধ–খ্রিস্টান কারো গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। তারা বাংলাদেশের নাগরিক, পাশের তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।