অনেক মায়ের কোল বাঁচিয়ে চলে গেলেন মাহেরীন, ঘরে রইল দুই সন্তান

ওরাও তো আমার সন্তান, ওদের রেখে কী করে আসি, বলেছিলেন স্বামীকে

আজাদী ডেস্ক | বুধবার , ২৩ জুলাই, ২০২৫ at ৪:৪১ পূর্বাহ্ণ

ঘড়ির কাঁটা তখন দুপুর সোয়া একটা থেকে দেড়টার ঘরে; রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি এলাকায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিকট শব্দ করে আছড়ে পড়ে বিমানবাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান। মুহূর্তেই প্রতিষ্ঠানটির ‘হায়দার আলী’ নামে দ্বিতল ওই ভবন দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে। আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করে নেয় শ্রেণিকক্ষে থাকা ছোট ছোট শিশুকে। এদের বেশিরভাগই ছিল তৃতীয় এবং চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী, এত ক্ষিপ্র গতিতে বিমানটি আছড়ে পড়ে যে, আশপাশের এলাকাও কেঁপে ওঠে। সোমবার দুপুরের এ বিভীষিকায় মুহূর্তেই প্রাণ হারায় অনেক শিশু। তাদের সঙ্গে মারা যান আরেকজন; মাহেরীন চৌধুরী, যিনি মাইলস্টোনের ওই শাখায় কোঅর্ডিনেটর ছিলেন। সেখানে থাকা এবং পরে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে গিয়ে মাহেরিন নিজে বের হতে দেরি করেন।

মৃত্যুর আগ মুহূর্তে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে স্বামীর হাত বুকে নিয়ে মাহেরীন বলেছিরেন, ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? আমি আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি ওদের বাঁচাতে। খবর বিডিনিউজের।

মাহেরীনের ভাই মুনাফ মুজিব চৌধুরী বলেন, তার বোনের মনে জোর ছিল অনেক বেশি। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, বিমান দুর্ঘটনার কিছুক্ষণ পর ঠিক কে ফোন করেছিল বলতে পারব না। ফোন করে আমাদের পরিবারের একজনকে বলল, উনার অবস্থা গুরুতর। উনাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমাদেরকে যেতে বলেন।

ফোন পাওয়ার পরেই আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে যোগাযোগ করে সবাই মিলে হাসপাতালে যান মুনাফ। তিনি বলেন, বার্ন ইনস্টিটিউটে তারা যাওয়ার পরও জীবিত ছিলেন তার বোন। বার্ন ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাকে। গিয়ে আমরা তাকে পাই। তখনও উনি জীবিত ছিলেন; কথা বলছিলেন। কিন্তু তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। আসলে উনার মানসিক জোর ছিল অনেক।

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে মুনাফ বলেন, আগে বের হওয়ার সুযোগ থাকলেও মাহেরিন বের হননি। ওখানে যারা ছিলেন তারা আমাদের বলেছেন, উনি তো আসলে আগে বের হতে পারতেন। উনি আগে বের হননি। উনার শিক্ষার্থী যারা ছিল উনি তাদের আগে বের করার জন্য চেষ্টা করেছেন।

তিনি বলেন, এতে করে যেটা হয়েছে, উনি এত বেশি ধোঁয়া আর আগুনে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে, উনার শ্বাসনালি পুরোপুরি পুড়ে গিয়েছিল। পরে আইসিউতে নেওয়ার পর নিশ্চিত হতে পারি যে, উনার শ্বাসনালি পুরোপুরি পুড়ে গেছে।

দগ্ধ হওয়ার পর তাকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকরা জানান, তার শরীরের শতভাগই দগ্ধ হয়েছিল। আইসিইউতে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি।

সোমবার রাত ৯টার কিছু আগে আইসিউতেই মারা যান মাহেরীন চৌধুরী। গতকাল গ্রামের বাড়ি নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়িতে তার লাশ নিয়ে যান স্বজনরা। সেখানে জানাজার পর তার দাফন হয়। শেষে পারিবারিক করস্থানে বাবামায়ের কবরের পাশে শায়িত করা হয় মাহেরীনকে। এর আগে ভোরে ঢাকার উত্তরায় গাউছুল আজম জামে মসজিদে তার জানাজা হয়।

লাইফ সাপোর্টে নেওয়ার আগে স্বামীর সঙ্গে খুবই অল্প সময় কথা হয় মাহেরীনের। তার স্বামী মনসুর হেলাল বলেন, মাহরিন বলেছেন স্কুল ছুটির পর বাচ্চাদের নিয়ে বের হচ্ছিলেন। ঠিক তখনই গেটের সামনে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। নিজে দগ্ধ হলেও সে সময় তিনি বাচ্চাদের বাঁচানোর চেষ্টা করেন।

ওরাও তো আমার সন্তান, ওদের রেখে কী করে আসি : ‘ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? আমি আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি ওদের বাঁচাতে।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে মৃত্যুর আগ মুহূর্তে স্বামীর হাত বুকে নিয়ে এই কথাগুলো বলেছিলেন উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরী।

গতকাল বিকালে দাফন শেষে মাহেরীনের স্বামী মনসুর হেলাল সাংবাদিকদের বলেন, মাহেরীন অনেক ভালো মানুষ ছিল। ওর ভেতরে একটা মায়া ছিল সবাইকে ঘিরে। আগুন লাগার পর যখন অন্যরা দৌড়াচ্ছিল, ও তখন বাচ্চাদের বের করে আনছিল। কয়েকজনকে বের করার পর আবার ফিরে গিয়েছিল বাকি বাচ্চাদের জন্য। সেই ফেরাটা আর শেষ হয়নি। সেখানেই আটকে পড়ে, সেখানেই পুড়ে যায় আমার মাহেরীন। শেষ রাতে হাসপাতালে ওর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। আইসিইউতে শুয়ে শুয়ে ও আমার হাত নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরেছিল। বলেছিল, আমার সঙ্গে আর দেখা হবে না। আমি ওর হাত ধরতে গিয়েছিলাম, কিন্তু শরীরটা এমনভাবে পুড়ে গিয়েছিল যে ঠিকভাবে ধরতেও পারিনি।

মনসুর হেলাল বলেন, তবে সে মৃত্যুর আগে আমার বুকের কাছে মাথা যখন রেখেছিল; তখন ওকে (মাহেরীনকে) আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি তোমার নিজের দুই সন্তানের কথা একবারও ভাবলে না? সে বলেছিল, ওরাও তো আমার সন্তান। ওদের একা রেখে আমি কী করে চলে আসি? আমি আমার সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করেছি। তিনি বলেন, ওকে বাঁচাতে কিন্তু পারিনি। আমার দুইটা ছোট ছোট বাচ্চা এতিম হয়ে গেল।

বাবার বাড়ি নীলফামারী জলঢাকা উপজেলা বগুলাগাড়ী চৌধুরীপাড়া হলেও জন্মের আগে থেকেই পুরো পরিবার ঢাকায় বসবাস করতেন। মাহেরীনের বেড়ে ওঠা ও পড়ালেখা ঢাকায়। মাহেরীন ও তার আরো এক বোন, দুই ভাই রাজধানী ঢাকার উত্তরায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মহিতুর রহমান চৌধুরী ও সাবেরা খাতুন দম্পতির বড় মেয়ে। ১৯৭৯ সালের ৬ জুন রাজধানী ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন মাহেরীন চৌধুরী। তিনি ১৯৯৫ সালে এসএসসি এবং ১৯৯৭ সালে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিতুমীর কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স শেষ করে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একই বিষয়ে মাস্টার্স পাস করেন। শিক্ষাজীবন শেষে ২০০২০৩ সালের দিকে রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতার পেশায় নিয়োজিত হন। মৃত্যুর আগ পযন্ত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা মিডিয়াম শাখার তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির সমন্বয়ক ছিলেন। ২০০৮ সালে বিয়ে করেন মাহেরীন চৌধুরী। তার শ্বশুরবাড়ি শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার চরআত্রাই গ্রামে। স্বামী মনসুর হেলাল একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের জেনারেল ম্যানেজার। আয়ান রশীদ ও আদেল রশীদ নামে দুই ছেলে সন্তান রয়েছে তাদের। একজনের বয়স মাত্র ১৪ বছর; সে নবম শ্রেণিতে পড়ে। আরেকজন ছিল ও লেভেলের শিক্ষার্থী; যার বয়স ১৫ কি ১৬। অল্প বয়সেই মা হারা হলো বাচ্চা দুটি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশেষ মুহূর্তে বাবা মাকে খুঁজেছিল দগ্ধ উক্যছাইং
পরবর্তী নিবন্ধফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্য আরও বেশি দৃশ্যমান করতে হবে