অনেক কথা বলার ছিলো বাবা

শর্মিষ্ঠা চৌধুরী | শুক্রবার , ২৪ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৯:০৮ পূর্বাহ্ণ

বাবা, নিস্তব্ধ চারিদিক, প্রচন্ড অন্ধকার, চিৎকার করে কাঁদছে নীরবতা। তোমাকে রেখে এলাম তোমার শেষ গন্তব্যে যার কোনো ঠিকানা আমাদের জানা নেই। তোমার অস্তিত্ব মিলিয়ে গেছে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকা সেই আগুনের ভেতর সবাই বলে চিতার আগুন! আহা! একটা অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি। বাবা, তোমাকে একা রেখে স্বার্থপরের মতন আমরা ফিরে আসছিলাম আমাদের গন্তব্যে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছিলাম নিভে যাচ্ছে সেই আগুন, যে আগুনের ভেতর হারিয়ে গেছে তোমার সুখের স্বপ্নগুলো, আমাদের নিয়ে তোমার আনন্দের নীড়টা। হারিয়ে গেছে তোমার মায়াভরা চেহারাটা, হারিয়ে গেছে শত কষ্ট আর অভিমান লুকিয়ে রাখা তোমার হাসিমুখটা। হারিয়ে গেছে তোমার নির্লিপ্ত চাহনি, হারিয়ে গেছে তোমার ছোট্ট শহরটা, যে শহরটার আনাচে কানাচে প্রতিটা জায়গা ছিলো তোমার পদভারে মুখরিত।

হারিয়ে গেছে তোমার প্রিয় গ্রামটা যে গ্রামের প্রতিটি ধূলিকণা, সবুজ ঘাস আর ধানক্ষেত থেকে শুরু করে গাছের পাতাগুলোও তোমার সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। হারিয়ে গেছে তোমার হাতে লাগানো সেই জলপাই গাছটা! বাবা, ছোটবেলা থেকেই তুমি ছিলে আমার প্রিয় বন্ধু আমার যত কথা হতো তোমার সাথে। আমার কত কথা যে তোমার বুকের ভেতর জমা ছিলো, সেই কথাগুলোও কি আগুনের ভেতর চাপা পড়ে গিয়েছিল বাবা! আমার জন্য তোমার যে পাগলের মতন ভালোবাসা সেই ভালোবাসাটা কি আগলে রাখতে পেরেছিলে তুমি, নাকি সেই ভালোবাসাও মিলিয়ে গিয়েছিল চিতার আগুনে!

বাবা, জীবনের সবচেয়ে কঠিন একটা বাস্তব চিত্র শেষ করে তোমাকে একা রেখে আমাদের গাড়িটা আমাদের নিয়ে ছুটতে ছুটতে একসময় মাঠ, প্রান্তর পেরিয়ে অনেক দূর চলে গেলো, চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম সবকিছু আছে আগের মতন, শুধু কোথাও তুমি নেই, আর কোনোদিন খুঁজে পাবো না তোমায়।

আমি কাউকে বাবা বলে ডাকবো না। কেউ জানতে চাইলে বলবো বাবা নেই! বাবা নামের প্রিয় বন্ধুটাকে আমি আমার মনের কথাগুলো বলবো না! আমার বাসায় তোমার আসার অপেক্ষায় থাকবো না, বলবো না এখনো আসছো না কেন বাবা আর কতক্ষণ লাগবে!

বাবা, চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো সেই ছোট্টবেলার দিনগুলোর কথাতোমার হাত ধরে আমার স্কুলে যাওয়া, মায়ের সাথে রাগ করে তোমার কাছে আশ্রয় নেয়া, তারপর তোমার প্রশ্রয় পেয়ে আহ্লাদে গদ গদ হওয়া।

অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকা কখন তুমি আসবে, আসার পর সে কি আনন্দ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছি! কেনাকাটা করতে যাবো সেখানেও তোমাকে চাই ছোটবেলায় আমি খুব জ্বরে ভুগতাম, প্রায় সময় আমার ব্লাড টেস্ট করতে হতো। যেই সুঁইটা ঢোকানো হতো আমার আঙ্গুলে তুমি চোখটা বন্ধ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকতে। তোমার এই বাচ্চাসুলভ আচরণ দেখে আমি হাসতাম আর মজা পেতাম। দেখে মনে হতো সুঁইটা আমার না যেন তোমার আঙ্গুলে ঢুকেছে। আহা, আর কোনোদিন আসবে না সেই দিনগুলো!

বাবা, জানো আজও হঠাৎ কোনো কলিংবেলের শব্দে আমার মনে হয় এই বুঝি তুমি এলে। এখন আমার শুধু মনে হয় তোমার সাথে বসে অনেক কথা বলি, গল্প করি, কত কথা যে জমা হয়ে আছে তুমি জানো না। আমার গল্প, আমাদের গল্প, মুগ্ধর ছোট থেকে বড় হয়ে ওঠার গল্প, আরও কত কী! বাবা, খুব দেখতে ইচ্ছে করে তোমাকে, স্পর্শ করতে ইচ্ছে করে, জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করে, তোমার শার্টের গন্ধ নিতে ইচ্ছে করে সেই ছোট্টবেলার মতন মনে হয় অনেক দূরে কোথাও ঘুরে বেড়াই তোমাকে নিয়ে, বাবা বাবা ডাকতে ডাকতে তোমাকে পাগল করে তুলি

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টলার সব ভালো
পরবর্তী নিবন্ধজান্নাত লাভের অধিকারী সৌভাগ্যবানরা