দেশের অর্থনীতিতে চাপ কমছে না। নিয়ন্ত্রণে আসেনি প্রধান কয়েকটি সূচক। মূল্যস্ফীতি নিম্নগামী হলেও পণ্যের দামে নেই স্বস্তি। কর্মসংস্থানে সুখবর নেই। রিজার্ভ বাড়লেও টেকসই অবস্থান নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। রাজস্ব আহরণেও রয়েছে বিশাল ঘাটতি। বিশেষজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, অর্থনীতিতে স্বস্তি না ফিরলে বিপর্যয় হতে পারে। তারা আরও জানিয়েছেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় বাড়ছে না বিনিয়োগ। আর পুরনো ক্ষত খেলাপি ঋণ বাড়ছে। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে বিশাল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে গত ১৫ বছর দেশে একটি শ্রেণির কাছে ব্যবসা–বাণিজ্য আটকে ছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে তাদের ব্যবসা–বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। শেয়ারবাজারেও নেই সুখবর। অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়েছেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করে। ফলে দেশের অর্থনীতিতে কাটছে না শনির দশা; আসছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। অন্যদিকে দেশের শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরে অস্থিরতা চলছে। বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি নিঃস্ব ব্রোকার, ডিলার ও মার্চেন্ট ব্যাংকাররাও।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, সাধারণ মানুষের অবস্থা ভালো নয়। যদিও সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে– বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্স বেড়েছে, কমেছে মূল্যস্ফীতি। কিন্তু বাজারে এর প্রতিফলন নেই। নতুন করে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। বেকারত্ব বাড়ছে। বাড়ছে দারিদ্র্য।
পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা গেছে, অনাদায়ী ঋণ বেড়ে যাওয়া ও কিছু ব্যাংকের দুর্বল অবস্থায় আর্থিক খাতে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কিছু ব্যাংক অবস্থার উন্নতি ঘটালেও অনেক ব্যাংক এখনও দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। সুশাসন, ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, আইনগত আদায় এবং দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা অধিগ্রহণ না করলে আর্থিক খাতের এই দুর্বলতা স্থিতিশীলতায় বড় ধরনের সংকট তৈরি করতে পারে এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিঘ্ন ঘটতে পারে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, একটি দেশের অর্থনীতির সার্বিক অবস্থা মূল্যায়নে প্রাথমিকভাবে ১২টি সূচকের পর্যালোচনা করতে হয়। সেসব সূচকে দেখা যাচ্ছে, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এসব সূচকের মধ্যে রিজার্ভ, রেমিট্যান্স, আমদানি–রপ্তানির ভারসাম্য ও বিনিময় হারে বাংলাদেশ বড় সফলতা দেখিয়েছে। যদিও অন্যান্য সূচকে দৃশ্যমান তেমন কোনো উন্নতি নেই। যে কারণে অর্থনীতি কিছুটা ঘুরে দাঁড়ালেও মূলধারায় ফিরতে পারেনি বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আমরা জানি, বিগত সরকারের শেষদিকে এসে অর্থনীতির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সূচক রিজার্ভের পরিমাণ কমতে কমতে পৌঁছেছিল তলানিতে। বছরের ব্যবধানে সে রিজার্ভ বেড়েছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার। শুধু তাই নয়, এ সময়ে দেশের বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের আগের বিল পরিশোধ করা হয়েছে ৪ বিলিয়ন ডলার। বিদায়ী অর্থবছরে দেশের বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে উন্নতি ঘটেছে। এর কারণ বিশেষত রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয় বাড়ার কারণে। বাণিজ্য ঘাটতি ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ কমেছে। রপ্তানি আয় বেড়েছে ৭ দশমিক ৭০ শতাংশ। গত অর্থবছরে চলতি হিসাবে উদ্বৃত্ত থেকেছে ১৪ কোটি ৯০ লাখ ডলার; আর আগের অর্থবছরে ঘাটতি ছিল ৬ দশমিক ৬০ বিলিয়ন। এ ছাড়া কিছু ইতিবাচক দিকের মধ্যে রয়েছে দেশের মুদ্রাবিনিময় হারে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা। গত সরকারের অব্যাহত অর্থ পাচার ও হুন্ডির কারণে দেশের মুদ্রা বাজারে ছিল বড় ধরনের অস্থিরতা। সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে এতে এসেছে স্থিরতা। কমেছে মুদ্রাস্ফীতি। তবে আরও যে কয়েকটি সূচকে উন্নতি সম্ভব হয়নি, তা নিয়ে আশঙ্কার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আবার যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া গেলে তা কাটিয়ে তোলাও সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, আমাদের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হচ্ছে অনিশ্চয়তা। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, নির্বাচনকেন্দ্রিক অনিশ্চয়তা আছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা আছে, রাজনৈতিক সংঘাতের আশঙ্কা আছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি মোটেও ভালো নয়। এ রকম পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ করতে খুব দ্বিধাবোধ করেন। স্বভাবতই বিনিয়োগে আমরা তার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছি। তাঁরা বলেন, অর্থনৈতিক সূচকগুলোর পতন থামানো এবং অর্জনগুলোকে সংহত করার প্রক্রিয়া চলছে। কিন্তু সেখানে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে কেউ বিনিয়োগ করতে চাচ্ছে না। বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বেকারত্বের হার বাড়ছে। কর–জিডিপির হার কম। নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে ব্যাংক ও আর্থিক খাতে। বিদেশি ঋণের দায়দেনা বেশি। রপ্তানি ক্ষেত্রে শুধুমাত্র গার্মেন্টসের ওপর নির্ভর করলে হবে না। রপ্তানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। এ জন্য বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। রপ্তানির নতুন নতুন বাজার বের করতে হবে।