অনিশ্চয়তা কেটেছে, অর্থ দেবে সরকার ও বিপিসি

ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ ধারণ ক্ষমতা ৩০ লাখ টন, অগ্রধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে সরকার

হাসান আকবর | বুধবার , ৯ জুলাই, ২০২৫ at ৬:৩৪ পূর্বাহ্ণ

দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগার ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণে বিদেশি সহায়তা কিংবা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ নয়, সরকারই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। সরকার এবং বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) যৌথভাবে প্রকল্পটির খরচের যোগান দেবে। ফলে বিগত সরকারের পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ এবং এস আলম গ্রুপকে রিফাইনারির অংশীদার করার উদ্যোগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাতিল করার পর যে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল তা কেটে গেছে। বর্তমান সরকার নতুন উদ্যোগে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের প্রকল্প শুরু করতে যাচ্ছে। বিপিসির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, দেশে জ্বালানি তেলের চাহিদা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে দেশে বছরে প্রায় ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এই বিপুল পরিমাণ তেলের সামান্য অংশ ক্রুড অয়েল হিসেবে আমদানি করে ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন করা হয়। ইস্টার্ন রিফাইনারি বছরে ১৫ লাখ টন ক্রুড অয়েল রিফাইন্ড করতে পারে। গত অর্থবছরে রিফাইনারিতে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টন তেল পরিশোধন করা হয়। চাহিদার বাকি তেল পরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করতে হয়।

ক্রুড অয়েল থেকে রিফাইন্ড অয়েলের মূল্য চড়া। এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে পরিশোধনের সক্ষমতা বাড়ানো গেলে জ্বালানি নিরাপত্তার পাশাপাশি প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা রক্ষা পেত। কিন্তু ইস্টার্ন রিফাইনারিতে পরিশোধন ক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব না হওয়ায় ১৯৬৮ সাল থেকে একই ধাঁচে চলে আসছে। শত শত কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রায় বাড়তি অর্থ ব্যয় করে পরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানি করতে হচ্ছে। ইস্টার্ন রিফাইনারির সক্ষমতা বাড়ানো গেলে এই বাড়তি খরচ সাশ্রয় করা সম্ভব হতো বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করেছেন। বিশেষজ্ঞদের এমন পরামর্শের প্রেক্ষিতে দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত রিফাইনারিটির উৎপাদনক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ২০১০ সালে গ্রহণ করা হয়েছিল ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণ প্রকল্প। বছরে ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল পরিশোধনের ক্ষমতাসম্পন্ন ইস্টার্ন রিফাইনারি২ নামে নতুন একটি রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিল। প্রকল্পটির ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৩ হাজার কোটি টাকা। পতেঙ্গায় ইস্টার্ন রিফাইনারির ২শ একর জায়গার এক পাশে ৭০ একর জায়গায় দ্বিতীয় ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ১৪ বছর ধরে ঢিমেতালে চলা প্রকল্পটির ব্যয় ইতোমধ্যে ২৩ হাজার ৫৯ কোটি টাকায় ঠেকেছে। বিপিসি নানাভাবে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করে সফল না হওয়ায় সরকারের কাছে একটি প্রস্তাবনা দিয়েছিল। এতে বিপিসি ৩০ শতাংশ অর্থ যোগান দেওয়ার এবং বাকি ৭০ শতাংশ অর্থ সরকারের তহবিল থেকে ঋণ হিসেবে নেওয়ার প্রস্তাব দেয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাবটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর পর বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে সরকার এতে অর্থায়নের সম্মতি জানিয়েছিল। প্রকল্পের সর্বমোট ২৩ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকার মধ্যে সরকার ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকা এবং বিপিসি ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা প্রদান করার কথাবার্তা চূড়ান্ত হয়। প্রকল্পের বাকি ৪৯৩ কোটি টাকার সংস্থান না হওয়ায় তা বিপিসি যোগান দেওয়ার ব্যাপারেও সম্মত হয়েছিল। সরকারি তহবিল থেকে নেওয়া ১৬ হাজার ১৪২ কোটি টাকার ঋণ বিপিসি ২০ বছরের মধ্যে ৫ শতাংশ সুদসহ পরিশোধ করার কথা।

বিষয়টি নিয়ে বেশ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর উদয় হয় এস আলম গ্রুপ। তারা প্রকল্পটিতে অর্থায়নের প্রস্তাব দেয়। ‘ইনস্টলেশন অব ইআরএল ইউনিট২’ শীর্ষক প্রকল্পটি ইআরএল এবং এস আলম গ্রুপের সাথে এমওইউ স্বাক্ষর করা হয়। এস আলম গ্রুপের পক্ষ থেকে ৩০ লাখ টনের পরিবর্তে ৫০ লাখ টন শোধনের ধারণক্ষমতা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এতে প্রকল্প ব্যয় ২৩ হাজার কোটি থেকে বেড়ে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা হবে বলে ঠিক করা হয়। এস আলম গ্রুপের সাথে যৌথভাবে ইস্টার্ন রিফাইনারি নির্মাণের ব্যাপারে নানা প্রক্রিয়া চালানো হয়। প্রকল্পের ডিপিপি প্রস্তুত করে দেওয়া হয় মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় থেকে ফাইল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। ওখান থেকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসার আগেই ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতন হলে ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিটের সব কার্যক্রম থমকে যায়। ইতোমধ্যে দেশের হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে এস আলম গ্রুপ দিশেহারা।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ইস্টার্ন রিফাইনারির দ্বিতীয় ইউনিট কিংবা সম্প্রসারণ অনিশ্চয়তায় পড়েছিল। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার সেই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে ঘোষণা করে, কোনো গ্রুপের অংশীদারিত্বে নয়, নয় কোনো বিদেশি ঋণে, এই প্রকল্পের পুরো অর্থ সরকার এবং বিপিসি যোগান দেবে। ৫০ লাখ টনের পরিবর্তে আগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৩০ লাখ টন ধারণক্ষমতার ইস্টার্ন রিফাইনারি দ্বিতীয় ইউনিট নির্মিত হবে।

সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেছেন, আগের পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ছিল ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ইঞ্জিনিয়ারস ইন্ডিয়া লিমিটেড। ২০১৬ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠানটির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল বিপিসি। ওই পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের চুক্তির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে। এখন নতুন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করেই প্রকল্পটি শুরু করতে হবে।

বিপিসির দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রকল্পটিতে বিপিসি নিজস্ব তহবিল থেকে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে। বাকি অর্থের যোগান দেবে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নকালীন প্রতি বছর বাজেট থেকে এই প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ থাকবে। প্রকল্পটির প্রায় সবকিছু গুছানো থাকায় অচিরেই এটিকে ডিপিপি তৈরি করে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

উল্লেখ্য, ইস্টার্ন রিফাইনারি আমদানিকৃত ক্রুড অয়েল পরিশোধন করে পেট্রোল, অকটেন, ডিজেল, বিটুমিন, এলপিজি, জেট ফুয়েলসহ ১৭ ধরনের পেট্রোলিয়াম প্রোডাক্ট উৎপাদন করে। দ্বিতীয় ইউনিটেও একই ধরনের জ্বালানি উৎপাদিত হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাংলাদেশি পণ্যে ৩৫% সম্পূরক শুল্ক আরোপ ট্রাম্পের, কার্যকর ১ আগস্ট
পরবর্তী নিবন্ধঝুঁকিতে ঢাকাইয়া কলোনির ৩০০ পরিবার