(দ্বিতীয় ও শেষ পর্ব)
রুমে ফিরে জিনিসপত্তর গুছিয়ে রেখে পুরু কম্বলের তলায় ঢুকলাম। চোখ বুজলাম ঘুমাবার উদ্দেশ্যে, কিন্তু অদ্ভুত! লক্ষ করলাম– ঘুম আসছে না। শুধু এলোমেলো ভাবনা বিপুল জলরাশির মতো ভিড় করছে মাথায়। সুন্দর একটি মুখ বুকের আয়নায় উঁকি দিচ্ছে বার বার। চিনতে পারছি না। এ পৃথিবীর কাছ থেকে কি যে আমার চাওয়ার আছে সেটিই বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে আমার এই বেঁচে থাকাটা যেন কেমন অর্থহীন হয়ে যাচ্ছে ইদানীং! জানি, আমার এই অনির্দিষ্টতার পরিণাম ভয়াবহ। এই আড্ডা, ঘোরাঘুরি, কবিতা লেখার জন্যে আর বাঁচতে ইচ্ছে করছে না। তবে কেন বেঁচে আছি? কার জন্যে? কোন নারীর জন্যে? নাকি নিজের জন্যে? কিছুই ভেবে পাই না। মাঝে মাঝে মনে হয়ে শুধু কয়েকটা প্রতিশোধের জন্যে আমার এই বেঁচে থাকা।
কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না, উচ্চস্বরে ইন্টারকম বেজে উঠতেই ঘুমের বারোটা বাজলো। সকাল আটটা। এর আগের দু’বারই টাইগার হিলে গিয়েছিলাম সূর্যোদয় দেখতে, তাই এবারের জন্যে আয়োজন ছিল না। আধ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে নামতেই জানা বাবু জানালেন মি. সিনহা বিশেষ কাজে কলকাতা গেছেন। অবশ্য চিন্তার কোনো কারণ নেই কারণ তিনি অর্থাৎ জানা বাবু আমার লাভা ও কালিমপঙ যাবার বন্দোবস্ত করেই রেখেছেন। সাড়ে ন’টায় আমার জন্যে নির্ধারিত গাড়ি আসবে, আমি যেন তার আগেই ব্রেকফাস্ট সেরে আসি।
সকালের ধোঁয়াশে দার্জিলিং ভেদ করে যখন শিরিংদের রেস্টুরেন্টে পৌঁছলাম তখনও তাদের রুটি বানানো শেষ হয়নি। খাবারের জন্য তাই মিনিট পনের অপেক্ষা করতেই হলো। ব্রেকফাস্ট সেরে বিদায় নেবার সময় এ নেপালী পরিবারের নিখাদ আন্তরিকতা হৃদয় ছুঁলো আমার। শিরিংকে সাথে করে নিকটস্থ সুভেনিয়র শপে গেলাম; দোকানগুলো তখন সবেমাত্র খুলছে। মাঝারি দামের এক সেট স্টোনের অর্নামেন্ট গিফট দিলাম শিরিংকে। তার চোখের কোণা তখন চিকচিক করছে; কিন্তু হায় ভালোবাসার মতো দুঃস্বপ্ন দেখার নেশা আর আমার নেই। মাঝে মাঝে যদিও মন খারাপ হয়, ভীষণ একা লাগে। তবু কবিতা লেখার চেয়েও যে ভালোবাসায় কষ্ট বেশি ! শিরিং বিদায় দিলো, জানি না আর কখনও দেখা হবে কিনা।
কাঁটায় কাঁটায় দশটায় রওনা হলাম কালিমপঙয়ের উদ্দেশ্যে। সতের’শ রুপির চুক্তিতে দার্জিলিং–কালিমপঙ–লাভা–কালিমপঙ। দার্জিলিং থেকে সড়ক পথে কালিমপঙয়ের দূরত্ব পঞ্চান্ন কিলোমিটার। পুরো পথটাই উঁচু নিচু পাহাড়ের মাঝে বসানো। মেঘমুক্ত দিন তাই প্রায় মিনিট দশেক ধরে কাঞ্চনজঙ্ঘা আমাদের সঙ্গ দিলো। তার বরফ শুভ্র চূড়া মাঝে মাঝে ঝলসে উঠছে সূর্যের তির্যক রশ্মি লেগে। মিনিট পনের পরে ড্রাইভার একটি ছোট্ট হিল স্টেশনে চা বিরতি দিলো। অনেকটা টং–ঘরের স্টাইলে নির্মিত টি স্টলের জানালার ধারে বসেছি। গয়ালের ঘনদুধের চা’য়ে চুমুক দিতে দিতে আশেপাশের ঘন জঙ্গলের সবুজ দেখতে লাগলাম। চড়া রোদের কারণে ঠাণ্ডা ভাবটা অনেক কমে এসেছে। ঠিক এই মুহূর্তের অনুভূতি আসলে ব্যাখ্যাতীত। আমি একা, সুবিশাল এ পাহাড়ি অরণ্যে; আর অদ্ভুদভাবে এই নিঃসঙ্গতাই ভালো লাগতে লাগলো।
বিরতি শেষে গাড়ি আবার চলা শুরু করলে পিছনের সিটে হেলান দিয়ে একটু ঘুমিয়ে নিলাম। ড্রাইভারের ডাকাডাকিতে চোখ মেলে দেখলাম খুব বেশি চওড়া নয়–এমন চারটি রাস্তার সঙ্গমস্থলে গাড়ি দাঁড়িয়ে। আশেপাশে আরও অনেকগুলো গাড়ি, দোকান পাট, মানুষের ভিড়। জিজ্ঞেস করে জানলাম এটাই কালিমপঙ বাস স্টেশন। কালিমপঙয়ের বিভিন্ন গ্রাম এখান থেকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছে বিভিন্ন দিকে। গাড়ি রি–ফুয়েলিং হবে এখানে। খিদে জানান দিচ্ছে থেকে থেকে, তাই পেটের রি–ফুয়েলিং জরুরি। ভেজিটেবল রোল ও খানিকটা চাউমিন সহকারে লাঞ্চ সারলাম। তারপর প্রথমে ফ্লাস্কের গরম জলে তারপর ঠাণ্ডা জলে মুখ হাত ধুয়ে নিলাম। একেবারে তরতাজা অনুভূতি হলো।
আমার এবারের গন্তব্য কালিমপঙয়ের পঁয়ত্রিশ মাইল পূর্বের পাহাড় চূড়া ‘লাভা’। যেহেতু আমি কালিমপঙয়ের অন্যান্য জায়গায় যাইনি বা কালিমপঙয়েওে থাকিনি তাই কালিমপঙ নিয়ে বিস্তারিত কিছু লিখছি না। দু’পাশে ঘাসের ঘন–সবুজ গালিচা সদৃশ ক্ষুদ্র প্রান্তর মাঝ দিয়ে সাপের মতো লকলকিয়ে উঠে গেছে পিচ ঢালা মসৃণ কালো রাস্তা। পুরোটা পথই একেবারে খাড়া উঠে গেছে লাভা অব্দি। বাইরে থেকে যা দেখলাম তাতে লাভাকে পাহাড় চূড়ায় একটি উদ্যানের মতো মনে হলো। টিকেট কেটে গাড়ি নিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে। ঢুকেই নিঃশ্বাস আটকে গেল রকমারি পুষ্প উদ্যানের শোভা দেখে। দেশি–বিদেশি অজস্র ফুলের ফুলেল গালিচা কেউ যেন বিছিয়ে রেখেছে পার্কওয়ের দু’পাশ জুড়ে। একটু উঁচুতে হেঁটে উঠে দেখলাম সবুজ ঘাসে মোড়া ছোট একটি মাঠ যার একপাশে ঞঁফড়ৎ জবারাবষ আর্কিটেকচারে গড়ে তোলা তিন তলা একটি হোটেল কাম রেস্টুরেন্ট। প্রকৃতির নৈসর্গিক দৃশ্যের একপাশে এই একমাত্র মূর্ত দালান যা ছবির মতো দাঁড়িয়ে আছে। যদিও থাকবার কোন সুযোগ নেই, তাও স্রেফ কৌতূহল বশতঃ হোটেলটিতে ঢুকলাম। স্কটিশ ঢঙে ইন্টেরিয়র করা চমৎকার ভেতরের পরিবেশ যেখানে শেতাঙ্গ পর্যটকদেরই আধিক্য বেশি চোখে পড়লো।
সময় স্বল্পতার কারণে একটু পরেই চলে এলাম আবার উদ্যানের মাঝে। হাঁটার জন্যে উন্নত পেভিং ব্লকে নির্মিত ওয়াকওয়ে, দু’পাশে উজ্জ্বল রঙের ফুলের গাছ। আর তারই মাঝে মাঝে সারিবদ্ধ ফারট্রি ও পাইনের সমারোহ। এবার আসা যাক লাভার আসল সৌন্দর্যের বর্ণনায়। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে লাভার উচ্চতা ও সূচালমুখী গঠন আয়তনের কারণে বাতাসের চাপ এখানে অপেক্ষাকৃত কম। ফলে মেঘের দল প্রায়শই থাকে হাতের নাগালে। কখনও কখনও পা ভেদ করে যায়। লাভাকে এক কথায় মেঘরাজ্য বা মেঘকন্যাও বলা যায়। প্রচণ্ড উৎসাহ নিয়ে পার্কের বেঞ্চের আশেপাশে ভাসতে থাকা কয়েকটি মেঘের মধ্যে ঢুকে গেলাম। পরক্ষণেই বেড়িয়ে এলাম স্যাঁতস্যাঁতে অনুভূতি ও লেপটানো কাপড় নিয়ে। খেলাটা বেশ জমে গেল কিছুক্ষণের জন্যে। পাহাড়ের চূড়া বেয়ে ধীরে ধীরে মেঘেরা উঠে আসে উদ্যানে আর সে মেঘের মাঝে ফুড়ুৎ করে ঢুকে যাই আমি। বেড়াতে আসা আশেপাশের অনেক তরুণ তরুণীও আমার দেখাদেখি এই মেঘস্নানে যোগ দিলো। এরপর বেশ কিছুক্ষণ ছবি তোলা। তারপর অনুমতি নেই তবুও পার্কের বেঞ্চিতে শুয়ে শুয়ে ধোঁয়াশে সেই বিশাল আকাশটা দেখতে লাগলাম।
এভাবে কতক্ষণ ছিলাম জানি না, ড্রাইভার এসে ডাকতেই ঘড়ি দেখলাম, বেলা তিনটা। সমতলে অর্থাৎ শিলিগুড়িতে পৌঁছুতে পৌঁছুতে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টা। উঠে এলাম, ড্রাইভারের পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম মূল ফটকের কাছাকাছি। এতক্ষণ যা চোখে পড়েনি এবার তা দেখলাম। বামদিকে ঢালুতে বিশাল এক কৃত্রিম জলাশয়, যদিও বৃষ্টির অভাবে জল তখন নিঃশেষ প্রায়। পাড়ের ছোট ছোট রঙিন বোট দেখে বুঝলাম এখানে রাইডিং এর ব্যবস্থাও আছে।
কালিমপঙয়ে গাড়ি বদল করে শেয়ারিং জিপে চড়ে যখন শিলিগুড়ি পৌঁছালাম তখন সন্ধ্যা নামছে তার অন্ধকারের পাখা মেলে। গতকাল রাতেই ফোনে টিকেটের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তাই হাতে অঢেল সময় কাটাতে কিছু খুঁজে না পেয়ে দু’তিনটে শপিং মল ঘুরে ঘুরে দেখলাম। কিছুক্ষণ সময় কাটালাম সাইবার ক্যাফেতে। রাত আটটা বাজতে রিকশা ধরে পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি ট্রেন স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মেই এক দোকান থেকে রুটি ও আলুর সুস্বাদু তরকারি সহযোগে ডিনার সারলাম। ডেজার্ট হিসেবে খেলাম দু’পিস পাহাড়ি সুমিষ্ট পেঁপে।
মধ্যরাত্রি কখন উতরে গেছে জানি না। লালচে আভার আকাশ দেখে ঝড় আসবে মনে হলো। প্ল্যাটফর্মে লোকের আনাগোনাও কমে গেছে। পাশের বেঞ্চে বসে থাকা কয়েকটি পরিবার গল্পরত, এলোমেলো হাওয়া তাদের আলাপচারিতার শব্দাংশ উড়িয়ে নিচ্ছে। অন্ধকারে কারো মুখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই নিজেকে খুব একা মনে হলো। এভাবে নিঃসঙ্গ ঘোরার চেয়ে বন্ধুদের সাথে নিয়ে পরবর্তী ট্যুরের পরিকল্পনা করতে করতে ট্রেন ঢুকলো প্ল্যাটফর্মে। প্রায় আড়াই ঘণ্টা লেট।
জানালার ধারে বসে দেখছি মেঘেদের ভিড়, ছুটন্ত সড়কবাতি আর অবতল চাঁদের ছেঁড়া ছেঁড়া জ্যোৎস্না। ট্রেন চলার ধারাবাহিক শব্দ ছাড়া অন্য কোন শব্দ নেই। শহরের কোলাহল এখানে পৌঁছোয় না। tuhin.dkhokan@gmail.com