আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে অন্ননালিতে ক্যান্সার রোগ। সম্প্রতি পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্তের প্রায় ১৪ শতাংশই খাদ্যনালির ক্যান্সারের রোগী। আর এ ধরনের রোগী বাড়ার পেছনে রয়েছে অপরিকল্পিত নগরায়নের ফলে সৃষ্ট দূষণ। এছাড়া মানহীন খাবার গ্রহণ, স্বাস্থ্য, সচেতনতার অভাব ও অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন।
খাদ্যে ভেজাল নতুন কোন বিষয় নয়। এ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরে ব্যাপক আলোচনা চলছে। প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য প্রতিবেদন। ভেজাল বিরোধী অভিযানও পরিচালিত হচ্ছে কিছুদিন পর পর। খাবারের মান নির্ণয় করতে রেস্তোরাঁগুলোর জন্য গ্রেডিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু সব কিছুর পরও দূষিত ও ভেজাল দেওয়ার বিষয়টি যেন নির্ভেজালই থেকে গেছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, সবার জন্য নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করাটাই এখন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। প্রতিদিন রাজধানীর ৬৩ লাখ মানুষকে মধ্যাহ্নভোজসহ দিন-রাতে হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু মানুষ জেনে বা না জেনে অথবা কোন উপায় না পেয়ে একরকম বাধ্য হয়ে নিম্নমানের খাবার পরিভোগ করছে। শুধু হোটেল-রেস্তোরাঁয় নিম্নমানের খাবার নয়, নিত্যপ্রয়োজনীয় সিংহভাগ পণ্যই ভেজাল বা বিষক্রিয়ার বাইরে নয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যে ভেজাল, নিম্নমানের খাবার, অনিরাপদ পানিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যে ভেজালের কারণে মানবস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রাজধানীর ২০০ খাবারের মান পরীক্ষার একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। প্রাথমিক রাজধানীর ২০০ হোটেল-রেস্তোরাঁ বেছে নেয়া হয়। পরীক্ষার জন্য দুঃখজনকভাবে মাত্র ৫০টির খাবার স্বাস্থ্যসম্মত বলে বিবেচিত হয়েছে। এর বাইরে আর রেস্তোরাঁগুলোর খাবার ফুডগ্রেডের অনেক নিচে। সম্প্রতি হাইকোর্ট এক আদেশে বলেছেন, খাদ্যে ভেজাল মেশানো, একটি বড় দুর্নীতি। আমরা অনেক বছর ধরে ভেজাল বিরোধী কিছু অভিযান পরিচালিত হতে দেখেছি। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ভেজালের বিরুদ্ধে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। কিন্তু ভেজাল রোধ করতে এসব অভিযান বা পদক্ষেপ প্রত্যাশিত সুফল দিতে পারেনি। প্রকৃতপক্ষে কেবল খাদ্যে নয়, ভেজাল রয়েছে সব জায়গাতেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, ভেজাল রোধ করা প্রায় অসম্ভব। বাংলাদেশ ছোট একটি দেশ, কিন্তু সংখ্যায় ভরপুর। এ কারণে এদেশে সমস্যার অন্ত নেই। ভেজাল, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি দূর করাও যেন মস্তবড় এক চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নিরাপদ খাদ্য ব্যবস্থাপনায় গুণগত পরিবর্তন আবশ্যক। আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে চাষাবাদের জন্য কৃষককে আগ্রহী করতে হবে। এছাড়া এক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অন্য প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগ ও সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটিয়ে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। সচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে নিরাপদ খাদ্য সম্পর্কে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সচেতনতার মাধ্যমে নিরাপদের ব্যাপক চাহিদা সৃষ্টি করতে হবে। এক গবেষণা সূত্রে জানা গেছে আমাদের শরীরে ৩৩ শতাংশ রোগ হওয়ার পিছনে রয়েছে, ভেজাল খাদ্য। পাঁচ বছরের নিচে শিশুর ৪০ ভাগ রোগ হয় দূষিত খাদ্য থেকে। খাদ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে খাবারের টেবিলে আসা পর্যন্ত নানা পর্যায়ে দূষিত হয়। এর মূল কারণ অসচেতনতা। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলে নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ করার কথা ভাবাও যায় না, চিন্তা করাতো দূরের কথা। কৃষিতে ঢালাওভাবে রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার হচ্ছে। এর ফলে শাকসব্জি ও ফলসহ বিভিন্ন খাদ্যের মাধ্যমে কীটনাশক মানুষের দেহে প্রবেশ করছে, যা শরীরের জন্য বিষবৎ। এ বিষয়ে কৃষকদের সচেতন করা অত্যাবশ্যক। সরকার কোন কীটনাশক নিষিদ্ধ করেছে কোনটার অনুমোদন দিয়েছে এবং কীটনাশক ব্যবহারের বিধিবিধান ইত্যাদি বিষয়ে কৃষকদের জানা বিশেষ দরকার। কৃষক বাজারজাত করার সময় খাদ্য দূষিত করেন। ক্রেতা ভালো পণ্যের সঙ্গে ভেজাল পণ্যের মিশেল ঘটিয়ে খাদ্যের দূষণ ঘটায়। এ দূষণ রোধ করার জন্য সচেতনতা বাড়ানো খুবই দরকার।
খাদ্য নিরাপত্তা বিষয়ক এক গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশের ৪০ শতাংশেরও বেশি খাবারে ভয়ংকর সব রাসায়নিক পদার্থ মিশানো হয়। যারা ভেজাল মেশায় তাদের ধরে আইনের আওতায় আনতে হবে এবং খাদ্যে ভেজালে জড়িতদের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান করতে হবে। একই সঙ্গে অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ভেজাল রোধে সরকারকে আরো অনেক বেশি সচেষ্ট হতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে একজন স্যানিটারি ইন্সপেক্টর দিয়ে কখনই ভেজাল রোধ করা সম্ভব নয়। ভ্রাম্যমাণ আদালতের গতি বাড়াতে হবে। বাংলাদেশের সব উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙে ও সব পৌরসভা তথা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অধীন স্যানিটারি ইন্সপেক্টরকে যুক্ত করলে অতিদ্রুত ভেজালের বিরুদ্ধে উদ্যোগটি সফলতার মুখ দেখবে। সরকারি ও বেসরকারি যে সব সংস্থা খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে তাদের সঙ্গে নাগরিক সমাজকেও ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন।