লোহাগাড়ায় অনলাইন জুয়ায় আসক্তি বাড়ছে মানুষের। এর ঘোরে সর্বস্বান্ত হারিয়ে অনেকে হচ্ছেন নিঃস্ব। ঘটছে হত্যা–আত্মহত্যার মতো ঘটনাও। এছাড়া বাড়ছে দাম্পত্য কলহের পাশাপাশি পারিবারিক অশান্তিও। অনলাইনে লোভনীয় বিজ্ঞাপনে এসব জুয়ার সাইটের ফাঁদে পা দিচ্ছেন নানা বয়স ও পেশার মানুষ। যার অধিকাংশই তরুণ। পিছিয়ে নেই স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। প্রথমে নিতান্ত কৌতূহলবশত আকৃষ্ট হচ্ছে তরুণরা। কম টাকা বিনিয়োগে শুরু করে পরে লোভে পড়ে হারাচ্ছে বড় অংকের টাকা। এসব টাকার সিংহভাগই চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। ফলে জাতীয় অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এটি।
জানা যায়, গত ১৪ জানুয়ারি লোহাগাড়া উপজেলার কলাউজান ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর কলাউজান রাবার ড্যাম স্টেশন এলাকায় এক মন্দিরের সামনে মো. জাহেদ (২০) নামে যুবকের মরদেহ পাওয়া যায়। সে একই ওয়ার্ডের রসুলাবাদ পাড়ার কোরবান আলীর পুত্র ও পেশায় নির্মাণ শ্রমিক। রাতে অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেনের জেরে বন্ধুরা তাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে। ঘটনার সাথে জড়িত একই এলাকার মো. ইউনুসের পুত্র মো. ইকবাল হোসেন ইমন (২২) ও নুরুল আমিনের পুত্র আনিসুর রহমান আসিফ (২১) নামে দুই বন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তারা আদালতে অনলাইন জুয়ার টাকা লেনদেনকে কেন্দ্র করে বন্ধুকে শ্বাসরোধে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করেছে। এছাড়া কয়েক বছর আগে উপজেলা সদরের এক ভাড়া বাসায় অনলাইন জুয়ায় নিঃস্ব হয়ে এক যুবক আত্মহত্যা করেছিল। সে পেশায় বিক্রয় প্রতিনিধি ছিলেন। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় অনলাইন জুয়া খেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে চলেছে বলেও জানা গেছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার সদর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলেও এই জুয়া বিস্তার লাভ করেছে। সহজে প্রচুর টাকা উপার্জনের লোভে পড়ে স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ এই জুয়ায় জড়িয়ে পড়ছে। তরুণদের অনেকে কৌতুহলবশত এই খেলা শুরুর পরে নেশায় পড়ে যাচ্ছে। প্রথমে লাভবান হয়ে পরবর্তী সময়ে হারাচ্ছে হাজার হাজার টাকা। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হওয়ায় ওই টাকা দেশীয় দালালদের মাধ্যমে দুই–তৃতীয়াংশই বিদেশে পাচার হচ্ছে। অনলাইনে অপরাধ সংঘটিত হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় অপরাধীরা। এছাড়া জুয়ার কারণে এলাকায় বেড়েছে চুরি–ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা অপরাধ।
অনলাইন জুয়ায় জড়িত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, অনলাইন জুয়া খেলতে প্রয়োজন স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট সংযোগ। স্মার্টফোনে বিভিন্ন নামের প্রায় ১০–১২টির মতো অ্যাপসে সবচেয়ে বেশি জুয়া খেলা হয়। এসব অ্যাপসে ১০ টাকা থেকে শুরু করে যেকোনো অংকের টাকা দিয়ে শুরু করা যায়। এসব খেলা স্বাভাবিক গেমের মতো হওয়ায় প্রকাশ্যে খেললেও আশপাশের মানুষ বুঝতে পারে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম অংশগ্রহণকারীদের জুয়ায় জিতিয়ে লোভে ফেলা হয়। এরপর নেশা ধরে গেলে একের পর এক টাকা হারানোর ঘটনা ঘটতে থাকে। তখন তারা বের হওয়ার পথ থাকে না। এটি নেশার মতো। খেলা শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে, ততক্ষণ খেলতে ইচ্ছে করে। এক সময় জুয়ায় সব টাকা হারিয়ে ঘরের জিনিসপত্র বিক্রি করতেও দেখা গেছে। এসব অ্যাপসের বেশির ভাগই পরিচালনা করা হচ্ছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও রাশিয়া থেকে। বাংলাদেশে তাদের এজেন্ট রয়েছে। লোহাগাড়ায়ও কয়েকজন এজেন্ট রয়েছে। তারা আড়ালে রয়েছে। তারা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ায় অংশগ্রহণকারীদের কাছ থেকে টাকা আদান–প্রদান করে থাকে।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক জানান, তার ছেলে স্থানীয় এক উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। কিন্তু অনলাইন জুয়ার কারণে পড়ালেখায় মনোযোগ নেই। কৌশলে টাকা নিয়ে জুয়া খেলে। কোনোভাবেই বিরত রাখা যাচ্ছে না। সঠিক সময়ে খাওয়া–ধাওয়া করছে না। পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে কথাও বলে না। অনলাইন জুয়া ছেলের ভবিষ্যৎ নষ্ট করে দিচ্ছে। অনলাইন জুয়ার সাইটগুলো বন্ধ ও গোয়েন্দা নজরদারি বাড়াতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি।
লোহাগাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আরিফুর রহমান বলেন, অনলাইন জুয়ার ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করতে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মাইকিং করা হচ্ছে। এছাড়া যাদের মোবাইলে অনলাইন জুয়ার অ্যাপস পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল আইনে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুহাম্মদ ইনামুল হাছান বলেন, জুয়ায় জড়িয়ে ঘটছে নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা। অনলাইন জুয়ার ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে উপজেলার সব ইউনিয়নে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। অভিভাবকদের সন্তানের প্রতি নজরদারি বাড়াতে হবে। সন্তান কোথায় যাচ্ছে, কার সাথে মিশছে ও কখন বাসায় ফিরছে এসব খেয়াল রাখতে হবে। এছাড়া অনলাইন জুয়ার বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।