চলমান করোনার এই মহামারিতে অনলাইনে কেনাকাটার প্রয়োজনীয়তা বেড়েছে বহু মাত্রায়। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে প্রতারণার ফাঁদ। হরহামেশাই শোনা যায় ফেসবুক কিংবা কোনো গ্রুপের পেজে যে পণ্য অর্ডার দেওয়া হয়েছিলো হঠাৎই আগাম অর্থ নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। আবার অনেক সময় অনলাইনে যে মানের পণ্য অর্ডার দেওয়া হয়েছিলো তা হাতে পাওয়ার পর ক্রেতার চোখ একেবারেই চড়কগাছ ! অনেক ক্রেতা অভিযোগ করছেন ওয়েবসাইটে প্রদর্শিত ছবির সঙ্গে পণ্যের মিল নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথাযথ তদারকি না থাকায় এমন প্রতারণার সুযোগ নিচ্ছে কিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। এ প্রসঙ্গে সিএমপির অতিরিক্ত উপ পুলিশ কমিশনার (মিডিয়া) আজাদীকে বলেন, সমস্যা হচ্ছে, এ ধরনের সমস্যায় পড়লে সচরাচর কেউ অভিযোগ করতে চান না। অভিযোগ করলে কিন্তু আমরা অ্যাকশনে যাচ্ছি, অপরাধীরাও ধরা পড়ছে। কিন্তু অভিযোগটা করতে হবেতো!
অনলাইন শপিংয়ের নিয়মিত কয়েকজন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে রকম পণ্যের ছবি দেখে তারা অর্ডার করেছেন, সে রকম পণ্য পাঠানো হচ্ছে না। ক্ষেত্র ভেদে খুবই নিম্নমানের পণ্য আসছে। এ ধরনের অভিযোগ বেশি আসছে মোবাইল হ্যান্ডসেট, হাতঘড়ি, ব্লেজার, শাড়ি প্রভৃতি পণ্য নিয়ে। গত এক বছর ধরে অনলাইনে পণ্য কেনাকাটা করছেন নগরীর মহসিন কলেজের শিক্ষার্থী শাওন আহম্মেদ। সপ্তাহ দুয়েক আগে তিনি জনপ্রিয় একটি অনলাইন থেকে নেভি ফোর্সের একটি ঘড়ি কেনেন সাড়ে চার হাজার টাকায়। এর একদিন পর তারই এক বন্ধু অন্য একটি অনলাইন মার্কেট প্লেস থেকে একই ব্র্যান্ডের একই ডিজাইনের ঘড়ি কেনেন আড়াই হাজার টাকায়। অর্থাৎ একই ব্র্যান্ডের ঘড়ি ক্রয় করতে দুই হাজার টাকা বেশি ব্যয় করতে হয়েছে শাওনকে। একই ধরনের অভিযোগ করেন শওকত জামিল নামে এক ব্যাংক কর্মকর্তা। তিনি বলেন, গত সপ্তাহে একটি অনলাইন শপিং সাইট থেকে বিভিন্ন কালারের কিছু টী শার্ট কিনেছিলাম এক হাজার ৪৮০ টাকায়। পরে দেখি একই ব্র্যান্ডের টীশার্ট অন্য একটি শপিং সাইটে মাত্র ৭৫০ টাকা। মার্কেট প্লেসের ভিন্নতায় এত বড় একটা প্রতারণা শিকার হবো বুঝতেই পারিনি। এই ক্রেতা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অনলাইন মার্কেটের জনপ্রিয়তা বাড়লেও এখনও সরাসরি বিপণিবিতান থেকে পণ্য কেনাই ভালো মনে হচ্ছে। এতে দর যাচাই করে পণ্য কেনা যায়। পণ্য দেখে ক্রয় করা যায়। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনলাইন কেনাকাটায় মানুষের আগ্রহ যেমন বাড়ছে, তেমনি অভিযোগ বাড়ছে। একই ব্র্যান্ডের পণ্য একেক সাইটে একেক রকম দাম। এতে একেক গ্রাহকের একেক রকম অভিজ্ঞতা হচ্ছে। নতুন করে যেসব উদ্যোক্তা ই-কমার্স ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বা নতুন করে আসছে তাদের অনেকেরই অনলাইন ব্যবসা সম্পর্কে দক্ষ ধারণা নেই। কিছু অদক্ষ ব্যবসায়ীর জন্য দক্ষ ব্যবসায়ীদেরও মান ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
আইনে ‘ক্রেতা সাবধানতা নীতি’ বা ক্যাভিয়েট এম্পটর একটা মতবাদ আছে। যেখানে ক্রেতাকে প্রতারণার শিকার হতে রক্ষার জন্য সচেতনতার উপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এ বিষয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ কেন্দ্রে অভিযোগের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু অনেক ক্রেতা এ তথ্য না জানায় এ ধরনের কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না। এই ক্ষেত্রে দেওয়ানি আদালতে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ ক্ষতিপূরণের মামলা করা যেতে পারে; ফৌজদারি আদালতে ৪২০ ধারার আওতায় প্রতারণার মামলা করা যেতে পারে; দ্যা সেলস অফ গুডস অ্যাক্টস এর আওতায় প্রতিকার পাওয়া যায়; চুক্তি আইনে প্রতিকার পাওয়া যায়। এমনকি প্রতিটি জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর অভিযোগের ভিত্তিতে প্রতিকার পাওয়া যেতে পারে।
করোনায় অনলাইন শপিংয়ের নামে প্রতারণা বেড়েছে স্বীকার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টার বলছে, অগ্রিম মূল্য পরিশোধ করেই প্রতারণার ফাঁদে পড়ছে অধিকাংশ মানুষ। এছাড়া পণ্য ডেলিভারির সময়ও প্রতারকের পাতা ফাঁদে পড়ে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন ক্রেতারা। আবার অবিশ্বাস্য রকম মূল্য হ্রাসের ঘোষণা দিয়ে ‘আর মাত্র ৩টি ফোন সেট বাকি আছে’ এরকম বিজ্ঞাপন ব্যবহার করে প্রলুব্ধ করছে ক্রেতাদের। ক্যাশ অন ডেলিভারির ক্ষেত্রে ক্রেতাকে নির্দিষ্ট কুরিয়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পণ্যের মূল্য পরিশোধ করে ডেলিভারি নেয়ার জন্য বলা হয়। পণ্য ডেলিভারি নেয়ার পর ক্রেতা দেখতে পান তাকে অন্য কোন পণ্য কিংবা নিম্নমানের পণ্য দেয়া হয়েছে। ক্রেতা পণ্য ফেরত দিতে চাইলে বলা হয়, এ প্যাকেজের সাথে রিটার্ন পলিসি না থাকায় রিটার্ন নেয়া সম্ভব নয়। কিংবা এ অবস্থায় বিক্রেতাকে ফেসবুকে নক করতে গিয়ে দেখা যায় তাকে আগেই ব্লক করে দেয়া হয়েছে।
সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার প্রতারক পেজগুলোর কিছু বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, প্রতারকরা তাদের পেজগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য বিভিন্ন কাস্টমারদের পজেটিভ রিভিউর স্কিনশট দেয়। তারা বিভিন্ন ফেইক আইডি থেকে ভালো ভালো রিভিউ দিয়ে রাখে তাদের সাইটে। তাদের পণ্য মূল্য বাজারের একই পণ্যের তুলনায় থাকে অবিশ্বাস্যরকম কম। এসব পেজের বিজ্ঞাপন অন্য কোনো পেজ থেকে কপি করা থাকে। যা নেটে সার্চ করলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রায় সব ক্ষেত্রেই তারা আগে টাকা দিতে বলে। এসব পেজগুলোর কোনো শোরুম থাকে না বা থাকলেও তা হয় ভুয়া। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এমন অনেক পেজ আছে যা তৈরি হয়েছিল কোনো নামকরা মডেলের ফ্যান ক্লাব হিসেবে। ফলে দ্রুতই সেটির লাইকের সংখ্যা বেড়ে লাখ ছাড়িয়ে যায়। পরে রাতারাতি ওই পেজের নাম ও ছবি চেঞ্জ করে তা কোনো প্রোডাক্টের মার্কেট প্লেসে রূপান্তর করা হয়। অনলাইনে কেনাকাটা করতে সাধারণ মানুষকে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টার। তারা বলেন, অনেক সময় সন্দেহজনক এরকম সাইটের এডমিনদের সতর্ক করা হচ্ছে। আবার অতি ক্ষতিকর সাইটগুলোকে বন্ধ করা হচ্ছে। নেয়া হচ্ছে আইনগত ব্যবস্থাও। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে নিজের বুদ্ধি বিবেচনা খাটানো। যে দামে পণ্য অফার করা হচ্ছে সত্যিই ওই দামে সেই পণ্য বিক্রি করা সম্ভব কিনা তা বিবেচনা করা। প্রতারিত হলে চুপচাপ না থেকে সিআইডির সাইবার পুলিশকে অবহিত করার পরামর্শ দেয় সিআইডি।