নুরুল: ঠিক আছে। লিখুন, আপনি লিখুন। পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে তাঁকে জানিয়ে দিন, আমার পরিচিত জগতে তিনিই একমাত্র সংস্কারমুক্ত উদার প্রকৃতির লোক। যাঁর কর্মে আদর্শ ও বাস্তবতার সমন্বয় সাধন হয়েছে। আপাতত দৃষ্টিতে যা-ই হোক, তিনি সন্তান-কল্যাণ আকাঙ্ক্ষায় নিবেদিত। কিন্তু তাঁর এই চিন্তা, তাঁর কন্যারত্ন এবং তার আদর্শ প্রেমিকের মধ্যে যে দুঃসহ যন্ত্রণার জগদ্দল পাথর হয়ে বিরাজ করছে, সে খবর তিনি রাখেন না। অতএব, সবিনয় নিবেদন, উভয়ের জন্য এবং তার প্রকৃত উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যায় কিনা।
পাটোয়ারী: কী আশ্চর্য কঠিন, অনমনীয় নিষ্ঠুর লোক! তুমি চিন্তা করো না। আমি লিখে দিচ্ছি। এই চিঠি পড়েও যদি মেয়ের বাবা তোমাদের বিয়েতে রাজি না হন তো বুঝতে হবে, তাঁর বুকের ভেতর হৃৎপিন্ডের জায়গায় একখন্ড পাথর বসানো আছে। নুরুল: আপনার তাই ধারণা?
পাটোয়ারী: অবশ্যই। আর সেজন্যই বলছি। কাল বিলম্ব না করে চিঠিখানি এই মুহূর্তে যথাস্থানে পৌঁছাবার ব্যবস্থা কর। নুরুল: তাই করব। কিন্তু মেয়ের বাবা যদি ক্ষেপে গিয়ে আমাদের দুজনকেই মারধোর করেন?
পাটোয়ারী: বলো কি! মানুষ হলে তা কখনও করতে পারে?
নুরুল: যদি মানুষ না হয়?
পাটোয়ারী: বাজে চিন্তা এখন রাখো। যা বলি শোন। চিঠিটা মেয়ের বাবার কাছে পৌঁছাবার ব্যবস্থা কর।
নুরুল: এই নিন! আপনার মেয়ে জেবুনকে আমি ভালবাসি।
পাটোয়ারী: কী? কী বলছো? আমার উদ্দেশ্যে এই চিঠি? আমাকে নিয়ে তামাশা! এতো বড়ো স্পর্ধা তোমার? তুমি, তুমি (রাগে কাঁপতে থাকেন পানাউল্লাহ পাটোয়ারী)।
জেবুন: (ছুটে এসে) আমাকে তুমি মাফ করো বাবা।
পেশাদার চিঠি লেখক এখন নেই। একটা সময় প্রতিটা গ্রামে ও পাড়া-মহল্লায় এবং নির্দিষ্ট কিছু স্থানে পেশাদার চিঠি লেখক ছিল। সেরকম একজন চিঠি লেখক পানাউল্লাহ পাটোয়ারী এবং তার মেয়ে জেবুন ও নুরুলের প্রেম, প্রেমপত্র, বিয়ের প্রস্তাবের দ্বন্দ্বমুখর নাটক চৌধুরী জহুরুল হক (১৯৪৭-২০০৮) রচিত ‘চিঠি’। নাটকটি ১৯৭৮ সালে রচনা করেন চৌধুরী জহুরুল হক। নাটকটির কল্যাণে বাঙালির একসময়কার চিঠি-সংস্কৃতি বিধৃত হলো। আর সুচরিত চৌধুরী টিংকুর সম্পাদনা ও নির্দেশনায় চৌধুরী জহুরুল হকের এগারতম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি থেকে ‘চিঠি’ নাটকটি মঞ্চায়ন করে আসছে চট্টগ্রামের ‘অনন্য থিয়েটার’। নাটকে পিতা-পুত্রী পাটোয়ারী ও জেবুন চরিত্রে অভিনয় করেন অনন্য থিয়েটারের সুশোভন চৌধুরী ও শ্রেয়সী স্রোতস্বীনী। যারা বাস্তব জীবনেও পিতা-পুত্রী। জেবুন চরিত্রটিতে প্রথম কয়েকটি মঞ্চায়নে ডলি দাশ অভিনয় করেছিলেন।
গত ২ জানুয়ারি অনন্য থিয়েটার পথচলার পঁয়ত্রিশ বছরে পদার্পণ করলো। ১৯৮৮ সালের ২ জানুয়ারি নাট্যসংগঠনটি আত্মপ্রকাশ করে। পঁয়ত্রিশ বছরে পদার্পন উপলক্ষে গত ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় পাথরঘাটায় সংগঠনের মহড়াকক্ষে আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। সংগঠনের প্রধান নির্দেশক সুশোভন চৌধুরীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন প্রবীণ নাট্যজন বিনোদিনী থিয়েটারের প্রতিষ্ঠাতা অনুপ মিত্র, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের প্রাক্তন প্রেসিডিয়াম মেম্বার মঞ্চমুকুট নাট্য সম্প্রদায়ের দলপ্রধান সুচরিত দাশ খোকন, চট্টগ্রাম থিয়েটারের দলপতি দীপক চৌধুরী, চট্টল থিয়েটারের দলপ্রধান শেখ শওকত ইকবাল, আসর নাট্য সম্প্রদায়ের তামরাজ, নাট্যজন লালন দাশ ও নাট্যমঞ্চ সম্পাদক জাহেদুল আলম।
গত চৌত্রিশ বছরে অন্যন্য থিয়েটার ছত্রিশটি নাটক মঞ্চে এনেছে। সংগঠনটির আবার নন্দিনী, মহাকাল, জন্মভূমি, হাউজ টু নো লেট, চাই হৃদয় চাই, ভূত ও ভবিষ্যৎ, বিশ্বরূপের সন্ধানে ব্যাপক আলোচিত নাটক। অনন্য থিয়েটারের পথনাটকগুলোর মধ্যে বিবিসাব, বিজয়ী বাঙ্গালি, বাংলাদেশের ঢোল, নেই মানুষের দেশে, বীরকন্যা, ফেরারি নিশান ও চোর-চোর উল্লেখযোগ্য। মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে সচুরিত চৌধুরী টিংকু রচিত ও নির্দেশিত ‘দ্রোণাচার্য’ শ্রীঘ্রই মঞ্চে আসছে। গত ৪ ডিসেম্বর থেকে অনন্য থিয়েটার মঞ্চায়ন করছে পথনাটক ‘গুজবে গজব’। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির অর্থায়নে নির্মিত নাটকটি রচনা করেছেন সুচরিত চৌধুরী টিংকু এবং নির্দেশনা দিয়েছেন সুশোভন চৌধুরী।
অনন্য থিয়েটারের সুশোভন চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী, ডলি দাশ প্রমুখ মঞ্চনাটকে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে প্রশংসিত। চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন মঞ্চে কাজ করে যাওয়া হাতেগোনা কয়েকজন অভিনেত্রীর মধ্যে ডলি দাশ অন্যতম। পঁয়ত্রিশ বছর যাবত দলের সাথে যুক্ত আছেন দীলিপ রুদ্র, তিলক চক্রবর্তী, মিঠু দাশ ও অরূপ গাঙ্গুলী। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সনজীবন চৌধুরী ও নাট্যজন্য সমীরণ চৌধুরীকে অনন্য থিয়েটারের সবাই গুরু অখ্যায়িত করেন। অনন্য থিয়েটারের অনন্য বৈশিষ্টগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে, মঞ্চে ধারাবাহিক নাটক উপস্থাপন। ‘জীবন যেমন’ নামক ধারাবাহিকটি ২০১০ সালে শুরু করেছিল। অনন্য থিয়েটারের তিনটি একক নাটক রয়েছে নাটকগুলো হচ্ছে বিদ্রোহী নূরলদীন, কেউ কথা রাখেনি ও অন্তহীন। ‘থিয়েটার পাঠাগার’ নামে অনন্য থিয়েটারের নিজস্ব একটি কার্যক্রম রয়েছে, যেখানে নাট্যবিষয়ক বিভিন্ন প্রকাশনা সংরক্ষিত আছে। ‘সারাদেশের পথনাটক’ নামে দেশের বিভিন্ন স্থানের নাট্যকারদের পথনাটক সংকলন প্রকাশ করেছে অনন্য থিয়েটার।
গত চৌত্রিশ বছর অনন্য থিয়েটার অনন্যসাধারণ নাট্যপরিভ্রমণ করেছে। ‘আমাদের যা কিছু করার করতে চাই মঞ্চে, যা কিছু বলার বলতে চাই নাটকে’ – এই কর্তব্যজ্ঞান হৃদয়ে ধারণ করে একনিষ্ঠ নাট্যসংগঠন অনন্য থিয়েটারের অবদানে ঋদ্ধ হোক সাংস্কৃতিক অঙ্গন ও সমাজ। জয় হোক নাটকের।