যাবতীয় প্রশংসা কেবলই আল্লাহ তাআলার যিনি সমগ্র জগতের মালিক ও রব। আর সালাত ও সালাম নাযিল হোক আমাদের নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর, যিনি সমস্ত নবীগণের সরদার ও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী। আরও নাযিল হোক তার পরিবার-পরিজন ও সমগ্র সাথী-সঙ্গীদের ওপর।
দোয়া ও মোনাজাত মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট অতীব পছন্দনীয় আমল। মহান রাব্বুল আলামীনের সাথে বান্দার নিবিড় সম্পর্কের সেতুবন্ধন হলো দোয়া ও মোনাজাত। মানব জীবনে দোয়া ও মোনাজাতের গুরুত্ব অপরিসীম। আভিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে শব্দদ্বয়ের মাঝে কিঞ্চিৎ পার্থক্য থাকলেও পারিভাষিক অর্থে শব্দ দুটি একে অপরের সম্পূরক। দোয়া ও মোনাজাতের মাধ্যমে মহান আল্লাহ তায়ালার নিকট বান্দা হতে পারে অতি আপন। পৌঁছতে পারে মনজিলে মকসুদে। তবে শর্ত হচ্ছে, দোয়া ও মোনাজাত হতে হবে খুশু-খুজু, আদবের সাথে ও শিরিক- বেদয়াত মুক্ত।
মোনাজাত এটি আরবি শব্দ। যার অর্থ হলো চাওয়া বা প্রার্থনা করা। মোনাজাত একটি গুরুত্বপূর্ণ আমল। আল্লাহ তায়ালা সাহায্য প্রার্থনাকারীকে বা মোনাজাতকারীকে অধিক ভালোবাসেন। দুনিয়ার কোনো মানুষের কাছে একবার বা দুবার কিছু প্রার্থনা করলে সে বিরক্তবোধ করে বা রেগে যায়। কিন্তু মহান আল্লাহ এমন এক মালিক, যার কাছে একবার নয় দুবার নয় হাজার বার প্রার্থনা করলেও তিনি নারাজ হন না। তার কাছে যত বেশি চাওয়া যায় তিনি তত বেশি খুশি হন। দুনিয়ার সমস্ত বাদশাহ অপরাধীকে খুঁজে শাস্তি দেওয়ার জন্য। কিন্তু একমাত্র আল্লাহ তায়ালা এমন বাদশাহ যিনি অপরাধীদেরকে তালাশ করেন শাস্তি দেওয়ার জন্য নয় বরং তাকে ক্ষমা করে দেওয়ার জন্য।
মোনাজাত আল্লাহর কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি আমল। যার কারণেই তিনি অভিশপ্ত শয়তানকে লানতের তক্তা গলায় ঝুলিয়ে দেওয়ার সময়ও তার কয়েকটি প্রার্থনা তিনি কবুল করেছিলেন। আল্লাহ তায়ালা মোনাজাতের ব্যাপারে এত দয়ালু যে, তিনি তার শত্রু আবু জাহেল, নমরুদ এমনকি ফেরাউনের মোনাজাতও তিনি কবুল করতেন।
কোনো হিন্দু, খ্রিস্টান, কাফের আল্লাহর কাছে কোনো সাহায্য প্রার্থনা করলেও তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন না। আল্লাহ তায়ালা সকলের দোয়াকেই কবুল করে নেন। তাই তো রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবিদেরকে বলতেন, তোমরা বেশি বেশি আল্লাহর অনুগ্রহ প্রার্থনা করো এবং সব বিপদ-আপদে একমাত্র তাকেই ডাকো, কেন না যাবতীয় সমস্যার সমাধানকারী একমাত্র তিনিই। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা প্রতিদিন শেষ রাতে প্রথম আকাশে এসে বান্দাদেরকে এ বলে ডাকতে থাকেন যে, কার কী প্রয়োজন আমার কাছে চাও।
আমি তোমাদের সব প্রয়োজন পূর্ণ করে দিব। কে কী অপরাধ করেছ? আমার কাছে ক্ষমা চাও ; আমি তাকে ক্ষমা করে দিব (আবু দাউদ)। আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমার রহমতের সাগর বিশাল বড়। কোনো অপরাধী যদি অপরাধ করে আমার কাছে ক্ষমা চায় তাহলে আমি ক্ষমা না করে থাকতে পারি না। অন্য এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, দোয়া হলো সমস্ত ইবাদতের মগজ। সহিহ্ বোখারি
দোয়া ও মোনাজাত আমাদের উত্তরাধিকার।
যুগে যুগে আম্বিয়ায়ে কেরাম (আ.) নিজেরা দোয়া ও মোনাজাত করেছেন এবং তাদের উম্মতদেরকেও এ জন্য নসীহত করেছেন। মহাগ্রন্থ আল-কোরআনে এর বহু নজির রয়েছ। হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে হযরত নূহ (আ.) হযরত হুদ (আ.) হযরত ইব্রাহিম (আ.) হযরত ইউসুফ (আ.) হযরত শুয়াইব (আ.) হযরত মুসা ও ঈসা (আ.)–সহ আরো অনেক নবীদের দোয়া ও মোনাজাত পবিত্র কোরআনে উল্লেখিত আছে।
আবু হুরায়রা (রা.)-থেকে বর্ণিত রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময় তেত্রিশবার সুবহানাল্লাহ, তেত্রিশবার আলহামদুলিল্লাহ, তেত্রিশবার আল্লাহু আকবার পড়ে এবং একশবার পূর্ণ করার জন্য একবার–লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহু লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইইন কাদির-পড়ে তার সব গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয় যদিও তা সাগরের ফেনাপুঞ্জের সমান হয়। (মুসলিম)।
হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, তোমরা ফরজ নামাজের পর বেশি বেশি দোয়া করো, কেননা আল্লাহ তায়ালা তখন তোমাদের দোয়াগুলোকে কবুল করে নিবেন (জামিয়ে তিরমিজি)। অন্য এক হাদিসে রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দোয়া হলো সকল ইবাদতের মগজ (বোখারি শরিফ)। রসুলের জামানায় কোনো সাহাবি বিপদে পড়লে রসুলের কাছে এলে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে দোয়া করতে এবং ধৈর্য ধারণ করতে বলতেন।
এক হাদিসে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, মানুষ গুনাহ করতে ভালোবাসে আর আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। কেননা তিনি গাফ্ফার অর্থাৎ ক্ষমাশীল (মুসলিম শরিফ) । অন্য জায়গায় রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তায়ালা ক্ষমাশীল এবং ক্ষমাকারীকে পছন্দ করেন।
অতঃপর হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-বলেন, রসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা যখন নামাজ হতে অবসর হও, তখন দোয়ায় মশগুল হও (তাফসিরে ইবনে আব্বাস ৫১৪)। রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, কেউ যদি সাগর পরিমাণ গুনাহ করে ফেলে অতঃপর আল্লাহর দরবারে এসে দুটি হাত তুলে ক্ষমা চায় আল্লাহ তায়ালা সঙ্গে সঙ্গে তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেন।
আল্লাহ তাআলা মানবজাতিকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। মানুষ যত পাপই করুক না কেন,লজ্জিত-অনুতপ্ত হয়ে এবং ভবিষ্যতে কখনো পাপ না করার দৃঢ়সংকল্প নিয়ে তওবা করে চোখের তপ্ত অশ্রু ফেলে ইস্তেগফার করলে আল্লাহ তাআলা অবশ্যই ক্ষমা করবেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সিজদায় বান্দা তার প্রভুর অধিক নিকটবর্তী হয়ে থাকে।
তাই তোমরা অধিক দোয়া করো। (মুসলিম)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-বলেছেন, তিন ধরনের লোকের দোয়া কখনো ফেরত দেওয়া হয় না। ইফতারের সময় রোজাদারের দোয়া, জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের দোয়া, বাড়িতে ফিরে না আসা পর্যন্ত মুসাফিরের দোয়া। (তিরমিজি)
মুমিন মাত্রই আল্লাহ তায়ালার কাছে বেশি বেশি তাওবা-ইস্তিগফার করে। হাদিস শরিফে এসেছে, হজরত আবদ ইবনে বসুর রা: থেকে বর্ণিত-রাসূলে আকরাম সা: বলেছেন, সেই ব্যক্তি সৌভাগ্যবান যে তার আমলনামায় অনেক বেশি ইস্তিগফার পেয়েছে। (ইবনে মাজাহ-১২৫৪)
একমাত্র আল্লাহর কাছেই দোয়া করা ; নিশ্চয়ই আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করবেন এমন বিশ্বাস নিয়ে দৃঢ়তার সাথে দোয়া করা ; বিনয় ও একাগ্রতার সাথে দোয়া করা, দোয়ার পূর্বে আল্লাহর প্রশংসা ও রাসূলে পাক (সা.) এর প্রতি দরূদ পড়া ; সমস্ত পাপ ও অপরাধ থেকে খালিস তাওবা করা, নেক আমলের উসিলা দিয়ে দোয়া করা ; বার বার দোয়া করা, দোয়ার শেষে আমীন বলা। আল্লাহ পাক আমাদের সেই তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : ইসলামি চিন্তক ।