আজ ২ ডিসেম্বর। পার্বত্য শান্তি চুক্তির রজতজয়ন্তী। চুক্তির পর পেরিয়ে গেছে ২৫ বছর। এ সময়ে বদলে যাচ্ছে পাহাড়ি জনপদ। সরকারি বেসরকারি নানা উন্নয়ন প্রকল্পে দৃশ্যমান অগ্রগতি এসেছে সড়ক যোগাযোগ, পর্যটন ও শিক্ষা খাতে। কৃষি ও পর্যটনে ভর করে অগ্রসর হচ্ছে পাহাড়ের অর্থনীতি। উন্নয়নের মাধ্যমে ক্রমশ সবুজ হচ্ছে ধূসর পাহাড়। পার্বত্য চট্টগ্রামের দুই দশকের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের অবসান ঘটাতে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও জনসংহতি সমিতির মধ্যে পার্বত্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। আর এ চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে পর্যটনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। বর্তমানের জেলার প্রায় ১ লক্ষ মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পর্যটনের উপর নির্ভরশীল। খাগড়াছড়ির সড়ক যোগাযোগে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। ৩শ ৯৭ কিলোমিটারের পাকা সড়কের পাশাপাশি বেইলি ব্রিজের পরিবর্তে নির্মাণ করা হয়েছে পাকা সেতু। সড়ক যোগাযোগ উন্নয়নের সুফল পাচ্ছে পর্যটন, কৃষি খাত।
খাগড়াছড়ি সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপ–বিভাগীয় প্রকৌশল সবুজ চাকমা বলেন, ‘পাহাড়ের সর্বত্র এখন পাকা সড়ক তৈরি হয়েছে। বেইলি ব্রিজের পরিবর্তে পাকা সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২শ ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে পিসি গার্ডার সেতু, আরসিসি সেতু এবং আরসিসি বক্স কালভার্ট। নির্মাণ করা হয়েছে মহালছড়ি সিন্দুকছড়ি সড়ক, ইস্টার্ন বাংলাদেশ ব্রিজ ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ি –
দীঘিনালা – বাঘাইহাট সড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে। এছাড়া বাঘাইহাট–মাচালং–সাজেক সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া দীঘিনালা–ছোটমেরুং–চংড়াছড়ি–লংগদু সড়ক উন্নয়ন করা হয়েছে।’
এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হওয়ায় পর্যটকদের যাতায়াতের পথ সুগম হয়েছে। ভোগান্তি ছাড়াই কৃষি পণ্য পরিবহন করা যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
শিক্ষা খাতেও ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। ২০১৭ সাল থেকে মাতৃভাষায় বই পাচ্ছে পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা। এছাড়া বিভিন্ন বিদ্যালয়ে একাডেমিক ভবনসহ অবকাঠামো নির্মাণ হওয়ায় শিক্ষা খাতে বড় অগ্রগতি হয়েছে। খাগড়াছড়ির শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মৃদুময় চাকমা বলেন, ‘শান্তি চুক্তির পরবর্তীতে পার্বত্য চট্টগ্রামের রিমোট এলাকাগুলোতে সরকার শিক্ষার উন্নয়নে প্রচুর কাজ করেছে। এর মধ্যে স্কুল পর্যায়ে সাতটি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া ১০টি ভবনের নির্মাণ কাজ চলমান। ৫টি কলেজে ভবন নির্মাণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
এছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা সম্প্রসারণ প্রকল্প থেকে দুইটি কলেজে ৪টি ভবন নির্মাণের কাজ চলমান রয়েছে। এ ছাড়া খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ১০০শয্যা বিশিষ্ট ছাত্রীনিবাস নির্মাণ করা হয়েছে।
শান্তি চুক্তি পরবর্তী সময়ে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় দুর্গম এলাকায় সুপেয় পানি সংকট নিরসনে বিভিন্ন প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি জেলার বাজারসমূহ ও নিকটবর্তী এলাকায় পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা প্রকল্প চলমান রয়েছে। এছাড়া জিপিএস এবং এনএনজিপিএস প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্প চলমান রয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী রেবাকা আহসান বলেন, ‘দুর্গম এলাকাগুলোতে পানি সরবরাহ করা হয়েছে। এতে করে মানুষের পানির কষ্ট দূর হয়েছে। চুক্তি পরবর্তী সময়ে খাগড়াছড়িতে সুপেয় পানির আওতায় এসেছে ৭০ শতাংশ মানুষ।
চুক্তি অনুযায়ী ভারত প্রত্যাগত প্রায় ১২ হাজারের বেশি পরিবারের ৫৪ হাজার ২শ ৬৩ জন শরণার্থীকে প্রতি তিন মাসে ৬৫ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এছাড়া শরণার্থী পরিবারগুলোর অপ্রাপ্ত বয়ষ্ক সদস্যদের প্রতি তিন মাসে ৩২ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। এছাড়া খাগড়াছড়ি জেলায় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির ৯শ ২৬ জন সদস্যকে প্রতি মাসে ১শ কেজি করে চাল দেয়া হয়। এতে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর খাদ্যের মৌলিক চাহিদা পূরণ হয়েছে বলে মনে করছেন জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুমাইয়া নাজনীন। তিনি আরো বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী সরকার নিরবচ্ছিন্নভাবে ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও জেএসএস সদস্যদের খাদ্যশস্য সহায়তা দিয়ে আসছে।’
পার্বত্য শান্তি চুক্তিকে পাহাড়ে আর্শীবাদ উল্লেখ করেছেন জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘চুক্তির আগে প্রান্তিক লেভেলে গিয়ে অবকাঠামো উন্নয়নসহ কাজ করার পরিবেশ ছিল না। আজকে অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে, সড়ক তৈরি হয়েছে, বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন হয়েছে। ট্যুরিস্টরা যেতে পারছেন। ফলে পর্যটন খাতে অর্থ সরবরাহ বেড়েছে। কৃষি খাতে অনেক উন্নয়ন হয়েছে। আম, মাল্টা, কাঁঠাল, কলা উৎপাদনে উদ্বৃত্ত হয়েছে। শান্তি চুক্তির ফলে এসব সম্ভব হয়েছে।’
উল্লেখ্য, এরই মধ্যে পার্বত্য শান্তির ৭২টা ধারার মধ্যে ৪৮টি ধারা বাস্তবায়িত হয়েছে।