ষাটের দশকে ছাত্রলীগের প্রথম সারির নেতা ওসমান গণি খান নীরবে চলে গেলেন। হয়তো অভিমানেই জীবন থেকে চুপিসারে নিষ্ক্রান্ত হলেন। যৌবনে ভরপুর জীবন যাপন করে শেষ জীবনে তিনি পাদ প্রদীপের আলো থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন।
ছাত্র রাজনীতিতে যে বিশেষ গুণটির জন্য তিনি প্রসিদ্ধি অর্জন করেছিলেন, সেটা হলো তিনি একটি শিল্পীসত্তার অধিকারী ছিলেন। তখন সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের ওপর একচেটিয়া অধিকার ছিলো ছাত্র ইউনিয়নের। এসএস ইউসুফ, ইদরিস আলম, গাজী গোফরান, শওকত হাফিজ খান রুশ্নি, কাজী ইনামুল হক দানু যখন ছাত্র রাজনীতিতে আসেন, তখন শিল্পে, সৃজনকর্মে ছাত্রলীগের কিছু অধিকার জন্মায়। তারপর ওসমান গণি খান, রবিউল হোসেন কচি–রা ছাত্রলীগের রাজনীতি আরম্ভ করলে সৃষ্টিশীল কর্মকাণ্ডের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছাত্রলীগের দৈন্য ঘুচে যায়। ওসমান গণি খান ছাত্রলীগের নিঃসঙ্গ শিল্পী ছাত্রনেতা ছিলেন।
ওসমান গণি খানকে আমি শিরোনামে ‘অগ্নিশিশু’ নামে আখ্যায়িত করেছি। সে আরেক অগ্নিগর্ভ ইতিহাস। চট্টগ্রামের ছাত্র–যুবকরা ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ভারত কাঁপানো একটি সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করেছিলেন। ১৯৬৮ সালে চট্টগ্রামের ৪ জন ছাত্র–জাফরুল আলম খান, ওসমান গণি খান, হারুনুর রশীদ খান ও সামশুল হক খোকন সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন, তাকে মাস্টারদার অগ্নিযুগের বিপ্লব প্রচেষ্টার সঙ্গে তুলনা করা হয়তো যথাযথ হবে না, তবুও ৬৮ সালের ঘটনা কোথায় যেন ৩০ সালকেই মনে করিয়ে দেয়। তাঁরা বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য গোপনে একটি সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের পরিকল্পনা করেছিলেন। ৬৮ সালে তার চেয়েও বড় ঘটনা ঘটেছিলো। সেটা ইতিহাসে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সৈনিকদের নিয়ে একটি সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে উক্ত সংগঠনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত ক্যান্টনমেন্টে একযোগে অভ্যুত্থান ঘটানোর একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। সেই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে পাকিস্তান সরকার ‘রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ নামে একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করেছিলো। বঙ্গবন্ধু ছিলেন মামলার ১নং আসামী, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন ২নং আসামী। পরে মামলাটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে পরিচিতি লাভ করে।
আগরতলা মামলা চলাকালেই চট্টগ্রামের উপর্যুক্ত ৪জন ছাত্র নেতা প্রাক্তন সৈনিক এবং চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বাঙালি সৈনিকদের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। প্রথমে তাঁরা প্রচারমূলক বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিয়েছিলেন। এই গোপন সশস্ত্র বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সূচনা হয়েছিলো চট্টগ্রাম সরকারি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ (বর্তমানে হাজি মহসিন কলেজ) থেকে। ১৯৬৭ সালে এই কলেজের কার্যক্রম শুরু হয়। ১ম বর্ষে যারা ভর্তি হয়েছিলেন, তাদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা সম্পন্ন কিছু ছাত্র ছিলো যাঁরা উক্ত সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পরিকল্পনা করেছিলেন। এই ছাত্রদের মধ্যে ওসমান গণি খান, মরহুম রবিউল হোসেন কচি, মরহুম শেখ আহম্মদ, মরহুম আনসার আলী, মরহুম সামসুজ্জামান বাবলু, মো. জামাল উদ্দিন, রেজাউল করিম, মাহবুবুল হক, মোহাম্মদ হোসেন, সাবেক মন্ত্রী ডা. আফছারুল আমিনের নাম উল্লেখযোগ্য, তাঁরা উক্ত কলেজে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের শাখা গঠন করেন। মোহাম্মদ হোসেন (চাঁদপুর) সভাপতি এবং জাফরুল আলম খান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি তখন বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা থেকে উদ্ভূত বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে দুর্বার গতিবেগ অর্জন করেছিল। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামের পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি বাঙালির মুক্তির ঐতিহাসিক সনদ ‘ছয় দফা’ জাতির সামনে উপস্থাপন করেন। ৬ দফায় বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিহিত ছিলো এবং স্বায়ত্তশাসন পেলে বাঙালির দৃষ্টিসীমার মধ্যে স্বাধীনতা প্রতিভাত হবে। এ কারণে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাতে থাকে। বিভিন্ন জেলা শহরে ৬ দফার বক্তব্য উপস্থাপন করতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হলেন মোট ১১ বার। ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, কুমিল্লা, ফরিদপুর এ সকল জেলে তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাখা হয়।
তাঁরা চীন বিপ্লবের মহানায়ক কমরেড মাও সেতুং এর রেড আর্মির আদলে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলেন যাঁরা নাম দেন ‘স্বাধীন সোনার বাংলা মুক্তি ফৌজ’। এদিকে ওসমান বন্ধু আলমগীরকে সাথে নিয়ে চকবাজার ও বাকলিয়ায় বসবাসরত কয়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্যদের সাথে আলাপ করে রাখল। সেনা সদস্যরা চট্টগ্রামের ক্যান্টনমেন্টের দায়িত্ব নিয়ে আশ্বস্ত করেন। এর মধ্যে সরকার (১৯৬৮ সালের মধ্যভাগে) এক ঘোষণায় ৩য় বিভাগে উত্তীর্ণদের কলেজে ভর্তি বন্ধ করে কেবল ১ম ও ২য় বিভাগে উত্তীর্ণদের কলেজে ভর্তিযোগ্য হিসেবে বহাল রাখে। সরকারের এ অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আবারও সোচ্চার হল পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ। এবার কিন্তু ছাত্ররা গ্রেপ্তার আতঙ্ক কাটিয়ে রাজপথ দখলে রাখলো। ওদিকে গোপন কথাটি গোপন থাকলো না। পাকিস্তান সরকারের ঠিকই খোঁজ পেয়ে গেলো ছাত্রদের গোপন সংগঠনের। ১৯৬৮ সনের ১০ আগস্ট গভীর রাত্রিতে বিশাল পুলিশবাহিনী দিয়ে জাফরের বাসভবন চারিদিক দিয়ে ঘেরাও করে গ্রেপ্তার করে লালদিঘির পূর্বপাড়ে অবস্থিত ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে গেল। উপস্থিত জিজ্ঞাসাবাদের পর কোতোয়ালী থানায় দু’দিন আটকিয়ে রাখে। এরপর ঢাকায় রিমান্ডে নিয়ে মালিবাগ মোড়ে অবস্থিত ডিবি কার্যালয়ের টর্চারিং সেলে বন্দী করে রাখল। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এলো কর্নেল নাসেরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের গোয়েন্দা দল। ওসমান, হারুন ও খোকনও পুলিশ খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলে। তাঁদের বিরুদ্ধে “সোনার বাংলা ষড়যন্ত্র মামলা” দায়ের করা হয়।
চট্টগ্রামের সংগ্রামী জনগণ এবার ছাত্রদের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নামলো। নতুনভাবে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হলো চট্টলা। জাফর, খোকন, ওসমান, হারুনকে মুক্ত করে আনবোই আনবো। অবশেষে সরকার বাধ্য হলো ১৯৬৯ এর ২২ ফেব্রুুয়ারি বিকেল ৫টার সময় তাদের ৪ জনকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতে। চট্টগ্রামের বীর জনতা ’৬৯ এর ২৫ ফেব্রুয়ারির লালদিঘির ময়দানে গণসংবর্ধনা দিয়ে তাদের চারজনকে ‘অগ্নিশিশু’ আখ্যা দিয়ে বরণ করে নেয়।
ওসমান গনি খান চট্টগ্রাম মহানগরের চকবাজার থানার ২৮ নম্বর খান মঞ্জিলে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা মৃত মো. ইসমাইল খান পেশায় একজন প্রখ্যাত মিষ্টি ব্যবসায়ী ছিলেন। মাতা ফাতেমা খান।
স্কুল জীবনে জনাব ওসমান গনি খান কাজেম আলী স্কুলের ছাত্র ছিলেন। উচ্চ মাধ্যমিকে তিনি ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমান মহসিন কলেজ) পড়াশোনা করে পরবর্তীতে চট্টগ্রাম কলেজে পড়াশুনা করেন। স্বাধীনাতার পরে তাঁর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়ার সুযোগ হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় তিনি প্রথমে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও পরে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন।
১৯৬৭ সালে মহসিন কলেজে পড়া অবস্থায় বন্ধুদের অনুপ্রেরণায় ওসমান গনি খান রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নির্বাচনী কমিটি গঠন করা হয়েছিল। ওই কমিটির সদস্য ছিল ওসমান গনি খান। ১৯৬৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের মিটিং–মিছিল, নির্বাচনী কাজে, কলেজ নির্বাচনের যত পোস্টার–ব্যানার এর লেখার কাজ সবগুলোতেই ওসমান গনি খান ছিলেন অদ্বিতীয়। নিজ হাতে এগুলো লিখতেন তিনি।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর এসএম ইউসুফ সকলকে নির্দেশ দেন ঘর থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসেন। ২৭ তারিখ দুপুরে তারা সকলে চলে আসেন নিউ হোস্টেলের ২৫ নম্বর রুমে। এসএম ইউসুফ তাদেরকে নির্দেশ দেন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চলে যেতে। ওসমান গনি খান–দের সাথে ছিলেন আবুল কাশেম চিশতী (রাঙ্গুনিয়া), ফজল করিম, ডা. মাহফুজুর রহমান, ইঞ্জিনিয়ার হারুন, ডাক্তার আমিন, ডাক্তার মাহবুব, ডাক্তার সালাউদ্দিন, কামরুল, মনি, বোরহান প্রমুখ। ওখানে তারা বেশ কয়েকদিন ছিলেন। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের হোস্টেলে ছিল তাদের অবস্থান। সেখানে এসএম ইউসুফ অস্থায়ী একটি ট্রেনিং ক্যাম্প করেছিলেন। কিছুদিন পরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহিম এসে যোগ দেন। হঠাৎ একদিন আতাউর রহমান খান কায়সার, এমএ মান্নান, বক্সিরহাটের এক সওদাগর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে এসে উপস্থিত হন। তাঁরা জানান, ‘পাকিস্তান আর্মি মদুনাঘাট পর্যন্ত এসে গেছে। সুলতানুল কবির চৌধুরী কোনও রকমে বেঁচে পালিয়েছে’।
একথা শোনার পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ক্যাম্প ছেড়ে সবাই ফটিকছড়ি হয়ে রামগড়ে পৌঁছান। রামগড় থেকে ওসমানকে ভারতে ট্রেনিং–এ পাঠানো হয়। ১৫ দিন ট্রেনিং নিয়ে আবার রামগড় ফিরে আসেন। ২ মে রামগড়ের পতন হলে সীমান্ত পার হয়ে তারা সাব্রুম যান। কিছুদিন পর সেখানে ছাত্রনেতা কাজী ইনামুল হক দানু আসলে তিনি ওসমানকে আগরতলা শ্রীধর ভিলায় বিএলএফ হেডকোয়ার্টারে নিয়ে যান। সেখানে ছিলো শেখ ফজলুল হক মনির অফিস। ওসমানকে শ্রীধর ভিলা দেখাশোনার দায়িত্ব দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হলে ওসমান ১৭ ডিসেম্বর শহরে ফিরে আসেন।
স্ব্বাধীনতার পরে তিনি চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সদস্য হয়েছিলেন; ওই কমিটির সভাপতি ছিলেন রবিউল হোসেন কচি। ওসমান গনি খান ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন, বড় ভাই মোহাম্মদ হোসেন খান খানের বাসায় থাকতেন। তার বড় ভাই মোহাম্মদ হোসেন খান চট্টগ্রাম ট্রান্সফার হয়ে চলে আসার কারণে তিনিও চট্টগ্রাম চলে আসেন। পরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় হঠাৎ তার বাবা মারা যান। বাবার মৃত্যুর পর তিনি তার বাবার ব্যবসার হাল ধরেন।
লেখক : সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংস্কৃতিক সংগঠক।