প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন জায়গায় অনেক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সংঘটিত হয়। এতে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়। এসব মৃত্যুর জন্য যতটা না আগুন দায়ী, তার চেয়ে অসচেতনতা বড় ভূমিকা রাখে। অগ্নিকাণ্ডে আক্রান্ত বেশির ভাগ মানুষই মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারে না। তাড়াহুড়ো করে পদদলিত হয়ে মারা পড়ে অনেকেই। আগুনে পুড়ে মরার চেয়ে অক্সিজেনের অভাবে দম বন্ধ হয়েই বেশি মারা পড়ে। অগ্নিকাণ্ডের সময় অনেকেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না তার এখন কী করা উচিত। থাকে না কোনো পূর্ব প্রস্তুতিও। তাতে মৃতের সংখ্যাই শুধু বাড়ে।
গত ৮ই জুন দৈনিক আজাদীতে ‘অগ্নিঝুঁকিতে নগরের পাঁচ ওয়ার্ড’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নগরের পাঁচটি ওয়ার্ড অগ্নিকাণ্ডের অধিক ঝুঁকিতে রয়েছে। এছাড়া শহরের আবাসিক ও বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত বহুতল ভবনগুলোর প্রায় ৯৭ শতাংশ আগুনের ঝুঁকিতে আছে। এসব ভবনের মধ্যে ৯৩ শতাংশের অগ্নিনিরাপত্তা সংক্রান্ত ছাড়পত্র নেই। এছাড়া বেশিরভাগ ভবন বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি) অনুসরণ না করায় বাড়ছে ঝুঁকির কারণ। পাশাপাশি শহরের যেসব এলাকার রাস্তা সরু সেখানে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ সরু রাস্তার ফলে অগ্নিনির্বাপণে আসা ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি সেখানে পৌঁছুতে সমস্যা হয়।
চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) প্রণীত ‘মাল্টি হ্যাজার্ড কন্টিনজেন্সি প্ল্যান ফর চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন’ বা চট্টগ্রাম শহরের আপদকালীন কর্মপরিকল্পনায় এসব তথ্য উঠে আসে। এতে অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকির কারণ, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি, অগ্নিকাণ্ডের আপদ মোকাবিলায় সক্ষমতা এবং অগ্নিকাণ্ড ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন সুপারিশ করা হয়।
অগ্নিঝুঁকিতে থাকা ওয়ার্ডগুলো হচ্ছে ২ নং জালালাবাদ, ৪ নং চান্দগাঁও, ১৬ নং চকবাজার, ৩২ নং আন্দরকিল্লা এবং ৩৬ নং গোসাইলডাঙ্গা। ফায়ার সার্ভিস আওতাধীন এলাকায় অগ্নিকাণ্ড ঘটার সংখ্যা এবং ক্ষয়ক্ষতির ওপর ভিত্তি করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। এছাড়া যেসব জায়গার আগুনের ঝুঁকি আছে সেগুলোর মধ্যে রয়েছে সরু রাস্তা, বিপত্তি বিধির অভাব এবং অপরিকল্পিত বস্তি, যথাযথ অগ্নি নির্বাপক উপকরণ এবং জরুরি প্রস্থান ছাড়া ভবন।
কর্মপরিকল্পনার তথ্য অনুযায়ী, নগরের সিইপিজেড এলাকা, উত্তর কাট্টলী এলাকা, ভেড়া মার্কেট বস্তির পাশে বেশি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তাছাড়া বায়েজিদ, কালুরঘাট ও বন্দর এলাকায় ফায়ার সার্ভিস আওতাধীন এলাকায় সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা সামপ্রতিক সময়ে ঘটেছে। কর্মপরিকল্পনায় ২ হাজার ৫৪১টি অগ্নিকাণ্ডের বিশ্লেষণ করে দেখানো হয় অগ্নি দুর্ঘটনার সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশই ঘটেছে আবাসিক এলাকায়। এছাড়া ২৭ শতাংশ বাণিজ্যিক এলাকায় ঘটেছে।
সমপ্রতি দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব অগ্নিকাণ্ড এবং বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। তাতে ঘটনায় প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে প্রচুর পরিমাণে। অগ্নিকাণ্ড আর বিস্ফোরণের কারণ এবং এসব ঘটনা এড়াতে করণীয় নিয়ে অনেকের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ঘটনার প্রকৃত কারণ জানাতে পারে না।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে এরকম বিস্ফোরণ বা অগ্নিকাণ্ডের পেছনে মানুষের অসাবধানতা এবং অজ্ঞতাকে দায়ী করছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। কর্মকর্তারা জানান, শুষ্ক মৌসুমে সারা বিশ্বেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। তবে মানুষ সচেতন হলে অনেকাংশে এসব দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব।
প্রতিবেদনে অধ্যাপক মো. শাহ জালাল মিশুকের পরামর্শ ও মতামত যুক্ত করা হয়েছে। তাতে তিনি অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি হ্রাসে পরিকল্পনা সম্পর্কে বলেন, ত্রুটিপূর্ণ ও অবৈধ বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ পর্যবেক্ষণ, মেরামত ও পরিবর্তন করতে হবে। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ বিষয়ক জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও অনুশীলনমূলক কার্যক্রম চালু রাখতে হবে। ভবনের স্থায়ী অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা, জরুরি নির্গমন সিঁড়ি, ফায়ার লিফট, ফায়ার কমান্ড স্টেশন স্থাপনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। বহুতল ভবন যদি ছয় তলার উপরে হয়, তাহলে সামনে ৩০ ফুট প্রশস্ত জায়গা থাকতে হবে। সিঁড়ি হতে হবে কমপক্ষে ছয় ফুট প্রশস্ত। প্রতি ৫৫০ বর্গফুটের মধ্যে একটি করে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র থাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, অগ্নিকাণ্ডের জন্য যদি পূর্বপ্রস্তুতি থাকে, তাহলে ক্ষয়ক্ষতি যেমন কমানো সম্ভব, বাঁচানোও সম্ভব অনেক অমূল্য প্রাণ। এ জন্য কিছু কিছু সাধারণ প্রস্তুতি থাকা উচিত সবারই। তাঁরা বলেন, অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়ে বিদ্যমান আইনের দৃঢ় প্রয়োগ নিশ্চিত করা জরুরি। কেউ অমান্য করলে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এ জন্য অগ্নি নিরাপত্তা পরিদর্শকদের প্রশিক্ষণ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোতে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ জরুরি। এর বাইরে সরকারি সংস্থা এবং স্থানীয় সমপ্রদায়ের মধ্যে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তোলায় প্রয়োজন।