মার্চ বাঙালি জাতির ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মাস। সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল মাস। এ ধরনের ঘটনা সহজে ঘটে না। ঘটতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়। অনেক কাঠ–খড় পোড়াতে হয়। ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। আন্দোলনে সংগ্রামের সুদীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়। তারপর একটি ঘটনা সংঘটিত হয়।
১৯৭১ সালে এদেশের মানুষ এরকম একটি আস্থার জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বাঙালী জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলেন। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতির অবিসংবাধিত নেতায় পরিণত হলেও সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার একক সংবাধিকতা অর্জন করেন। নির্বাচনে নিরঙ্কুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন পাকিস্তানের সাময়িক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় বিশ্বজনমত বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আসে। অসহযোগ আন্দোলন থেকে শুরু করে তিনি যেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেন তার প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ ভাবে আন্দোলন সংগ্রামের প্রতিটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় সবকিছু চলতে থাকে। মানুষ প্রতিদিন মিছিল সহকারে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে জড়ো হতো। সাধারণ মানুষ যে রাস্তায় নেমে এসেছে আর ঘরে ফিরে যেতে চায় না। বঙ্গবন্ধু উপস্থিত জনতার উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখতেন, বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রদান করতেন।
তেসরা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের কথা থাকলেও পহেলা মার্চ সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান বাতিলের ঘোষণা দিলে সমগ্র জাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। এর প্রতিবাদে দোসরা মার্চ ঢাকা শহরে হরতাল এবং তেসরা মার্চ সারা দেশে হরতাল কর্মসূচি দেওয়া হয়। তেসরা মার্চ সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। এর আগেও অনেক হরতাল হয়েছে কিন্তু এবারের হরতাল সবকিছু স্তদ্ধ হয়ে যায়, বন্ধ হয়ে পড়ে। এরকম হরতাল আগে কেউ দেখেনি। বিক্ষুদ্ধ মানুষেরা হঠাৎ যেন স্তদ্ধ হয়ে পড়ে। কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পায় না। বুঝতে পারে মিটিং মিছিলে আর কাজ হবে না। অপেক্ষা করতে থাকে ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের জন্য। সমগ্র জাতি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে চূড়ান্ত লড়াইয়ের জন্য। এদিকে একদিনের জন্যও রক্তপাত বন্ধ হয়নি। প্রতিদিন গুলি চলছে, নিরীহ মানুষকে হত্যা করে চলছে।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। পূর্ব বাংলায় এর আগে এত বিশাল জনসমাবেশ আর হয়নি। বৃহত্তর ঢাকা ও আশে পাশের নানা প্রান্ত থেকে হাজার হাজার মানুষ এসে জড়ো হয়েছে রেসকোর্স ময়দানে। সকাল থেকে মানুষ অপেক্ষা করেছে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। বেলা বাড়ার সাথে সাথে লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠেছে রেসকোর্স ময়দান। এত লোক সমাগম মানুষ আগে কখনো দেখেনি। হাজার হাজার মিছিল এসে রেসকোর্সে মিলিত হয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশ জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছে। অধীর আগ্রহ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করে আছে। বঙ্গবন্ধুর বজ্রকন্ঠ সাগরের ঢেউয়ের মত জনসমুদ্রের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ধ্বনিত হতে লাগলো। তাঁর অমোঘ বাণী তরঙ্গের মত অনুরণন তোলে মানুষের হৃদয় মনকে ছুঁয়ে যেতে থাকলো। তেজদ্বিপ্ত অবিস্মরণীয় এ ভাষণ মানুষকে স্বপ্নের ঠিকানায় পৌঁছার জন্য পথ নির্দেশনা দেয়। মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে। অঙ্গিস্কুলিঙ্গের মত অগ্নিঝরা এ ভাষণ সর্বস্তরের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য উদ্ধুদ্ধ করে তোলে। এ ভাষণের মধ্য দিয়ে জাতি সঠিক দিক নির্দেশনা খুঁজে পায়।
বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের পর পরিস্থিতি নতুন রূপ নেয়। এতদিনের আন্দোলন সংগ্রামরত মানুষেরা এবার প্রতিরোধ গড়ে তোলে। বাধা এলে সেখানে পাল্টা আঘাত হানতে চেষ্টা করে। শহর বন্দরে পাড়ায় মহল্লায় গ্রামে গঞ্জে সর্বত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। হাট বাজারে রাস্তার মোড়ে স্কুলের মাঠে প্রতিদিন মানুষ সভা সমাবেশে করে মিছিল করতে থাকে। পাকিস্তানের শাসক চক্রের বিরুদ্ধে শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল সারা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। এসবে তরুণেরা সবচেয়ে বেশি উদ্ধুদ্ধ হতে থাকে। তারা সবকিছুতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য তরুনেরা সবার আগে আগ্রহী হয়ে উঠে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী সবকিছু চলতে থাকে। তিনি যে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিয়েছেন তাতে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শাসন ব্যবস্থা কার্যত অচল হয়ে পড়ে। শিল্প কারখানায় উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। অফিস আদালতে কোন কাজ কর্ম চলে না। শ্রমিক কর্মচারী সবাই সাধারণ মানুষের সাথে আন্দোলনে যোগ দেয়। দিন যত যায় আন্দোলনের গতি তত বাড়তে থাকে। তীব্র আন্দোলন এক সময়ে সশস্ত্র আন্দোলনের দিকে ধাবিত হয়। মানুষেরা সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে শুরু করে।
১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। ১৯৭১ সালের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর ৫১ তম জন্মদিন। এদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অনেকে সমবেত হয়। এমনিতে বঙ্গবন্ধু কখনো জন্মদিন পালন করতেন না। বাংলার মানুষের হাজারো অভাব অনটনের মধ্যে জন্মদিন পালন করার মানসিকতা তার কখনো ছিল না। তবে এই বিশেষ দিনটিতে তিনি শিশুদের সাথে কাটাতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করতেন। তখনো শিশুরা তার কাছে আসতো। শত ব্যস্ততার মাঝেও তিনি শিশুদের সময় দিতেন। শিশু শুলভ আচরণের মাঝে ডুবে যেতেন। পরবর্তীতে এ দিনটি জাতীয় শিশু দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এ দিন শিশুরা আনন্দ উৎসবে মেতে উঠে। তবে একাত্তর সালে সতেরই মার্চ বঙ্গবন্ধু কিছুক্ষণ শিশুদের সাথে মিশে গিয়েছিল। সেদিন শিশুরা তাকে ক্ষণিকের জন্যে চিন্তামুক্ত করে দিয়েছিল। তাঁর হাস্যজ্জ্বোল মুখখানি শিশুদের হাসিমাখা কচিমুখের সাথে একাকার হয়ে গিয়েছিল। তিনি শিশুদের খুব ভালবাসতেন। এ ভালবাসা উত্তাল মার্চেও এ বিন্দু অমলিন হয়নি। তিনি জানতেন সামনে বিভীষিকাময় দিন। যে কোন সময়ে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করতে পারে। নিরীহ বাঙালির উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। তাকে গ্রেফতার করতে পারে। তিনি জেল জুলুমকে কখনো ভয় পাননি। জীবনের বড় একটা সময় তাকে জেলে থাকতে হয়েছে। তার চিন্তা দেশের মানুষকে নিয়ে। যাদের অধিকার আদায়ের জন্য তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। এবার কিন্তু আঘাত আসলে দেশের মানুষ পাল্টা আঘাত হানবে।
অপারেশন সার্চ লাইট নামে ২৫শে মার্চ যে বর্বর গণহত্যা চালায় তার পরিকল্পনা আরো আগে নেয়া হয়েছে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থাগিত করার পর পূর্ব বাংলার জনগণকে কি করে চিরতরে স্তদ্ধ করে দেয়া যায় তার নীল নকশা প্রণয়ন করে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের মধ্য দিয়ে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বুঝতে পেরেছিল বাঙালিদের আর দাবিতে রাখতে পারবে না। কিন্তু পাক সাময়িক জান্তা বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। ভবিষ্যতে পূর্ব বাংলার মানুষ যেন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে সেজন্য তারা একের পর এক বর্বরতা চালিয়ে যেতে লাগলো। প্রতিদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডে নিরীহ মানুষদের হত্যা করে চললো। এদিকে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈনিকদের অনেকে নির্বিচারে মানুষ হত্যাকে মেনে নিতে পারেনি। পুলিশ ও ইপিআর ভেতরে ভেতরে সংঘটিত হতে শুরু করলো। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে তারাও নির্দেশনা পেয়ে যায়। এত বছরের চরম অসন্তোষ যেন এক মোহনায় এসে মিলিত হয়। বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতা সংগ্রামে উদ্ধুদ্ধ হয়ে সবাই মুক্তিযুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
২৫শে মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি বাহিনী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিরীহ বাঙালির উপর অতর্কিত আক্রমণ করে গণহত্যা চালায়। নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে। সে রাতে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নং বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। তার আগে বঙ্গবন্ধু ইপিআরএর ওয়ার লেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। দেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে বলেন। বিশ্ববাসীর কাছে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সহযোগিতা কামনা করেন। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে নিয়ে যায়। পরের দিন অর্থাৎ ২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার তারবার্তা চট্টগ্রাম এসে পৌঁছে। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতৃবন্দ মাইকে স্বাধীনতা ঘোষনার তার বার্তাটি প্রচার করতে থাকে। একই সময়ে চট্টগ্রাম রেডিও থেকে তার বার্তাটি বার বার পাঠ করা হয়। ২৬ শে মার্চ ভোররাতের বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেশের মানুষ কাছে পৌঁছে যায়। বিশ্ববাসীও জানতে পারে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। অনেক বিশ্বনেতা বাংলাদেশের প্রতি নিজেদের সমর্থন ব্যক্ত করতে থাকে। ২৬ শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস। পরবর্তী সময়ে এর সাথে জাতীয় দিবসও যুক্ত করা হয়েছে। ১৯৭১ এর ২৬ শে মার্চ স্বাধীনতা ঘোষনার পর পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। স্বাধীন বাংলাদেশ নামে লাল সবুজের পতাকা নিয়ে মানুষ যুদ্ধে আবতীর্ণ হতে থাকে। যদিওবা মুক্তিযুদ্ধের সময় পতাকার মধ্যখানে পুর্ববাংলার মানচিত্র অংকিত থাকে । মূলত পূর্ব বাংলার মানুষ ৭ই মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সারা দেশে তরুণ যুবক দেশ প্রেমিক মানুষেরা সংগঠিত হতে থাকে। কৃষক শ্রমিক ছাত্র জনতা সব শ্রেণি শ্রেণির মানুষ মুক্তিযুদ্ধ অংশ নেয়ার জন্য অস্ত্রের ট্রেনিং নিতে শুরু করে। দেশে এবং দেশের বাইরে বিশেষ করে ভারতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। কয়েক সপ্তাহে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা দেশে ফিরে এসে আক্রমণ শুরু করে। নানা জায়গায় আক্রমণ চলতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সময় চোরগোপ্তা হামলা করে। পেছন থেকে আক্রমণ করে বসে। শত্রু সেনারা বুঝে উঠার আগে আক্রমণ শুরু করে। কোন কোন জায়গায় শত্রুরা পিছপা হতে বাধ্য হয়। দিন যত যায় আক্রমণ তত বাড়তে থাকে। হতাহতের সংখ্যাও বেড়ে যায়। মার্চ মাসে শুরু হওয়া এ যুদ্ধ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। লক্ষ লক্ষ মানুষ এ যুদ্ধে প্রাণ বিসর্জন দেয়। ১৬ই ডিসেম্বর পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য নিয়ে বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হয়। বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ স্থান করে নেয়।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী