গত বছরের মার্চ মাসে সংক্রমণ শুরুর দিকে করোনা আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় চট্টগ্রামে সরকারি দুটি হাসপাতাল নির্ধারণ করে করোনা মোকাবেলায় গঠিত হয় জেলা পর্যায়ের কমিটি। এর একটি ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি (বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস) হাসপাতাল। অপরটি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল।
করোনা রোগীদের চিকিৎসায় প্রস্তুতি হিসেবে বিআইটিআইডি হাসপাতালের ৩২টি এবং জেনারেল হাসপাতালের ১০০টি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুত করা হয়। জেনারেল হাসপাতালে আইসোলেশন শয্যা সংখ্যা বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত দেড়শ করা হয়েছে। রোগী ভর্তির মাধ্যমে শুরুতে এই দুটি হাসপাতালেই করোনার চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয় চট্টগ্রামে। যদিও এ দুটির একটি হাসপাতালেও আইসিইউ-ভেন্টিলেটর ও সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম কোনোটাই ছিল না। ছিল না অক্সিজেন প্লান্টও। পরে গত বছরের ২৩ এপ্রিল ভেন্টিলেটরসহ দশটি আইসিইউ শয্যায় সেবা চালু হয় জেনারেল হাসপাতালে। পরবর্তীতে অক্সিজেন প্লান্টের পাশাপাশি স্থাপন করা হয়েছে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেমও। সর্বশেষ চলতি বছরের ৮ এপ্রিল আরো ৮টি আইসিইউ শয্যা উদ্বোধন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন ১৮টি আইসিইউ শয্যা চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে। সরকারি অর্থায়নে বসেছে অক্সিজেন প্লান্ট। আর সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম স্থাপন করে দিয়েছে শিল্পগ্রুপ এস আলম পরিবার। এসব সুবিধা বিবেচনায় করোনা চিকিৎসায় চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল এখন অনেকটা স্বয়ংসম্পূর্ণ বলা চলে।
তবে একই সাথে করোনা চিকিৎসা কার্যক্রম শুরু হলেও চিকিৎসা সুবিধায় তুলনামূলক অনেকটা পিছিয়ে ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি হাসপাতাল। আইসোলেশন শয্যায় এখনো ৩২ জনের বেশি রোগী ভর্তির সুযোগ নেই এ হাসপাতালে। শ্বাসকষ্টের রোগীকে অক্সিজেন সাপোর্ট দিতে অক্সিজেন সিলিন্ডারই ভরসা। নেই আইসিইউ-ভেন্টিলেটর সুবিধা। তবে এবার বিআইটিআইডি হাসপাতালেও যুক্ত হচ্ছে এসব চিকিৎসা সুবিধা। ভেন্টিলেটরসহ ৫ বেডের আইসিইউ শয্যা বসছে এ হাসপাতালে। অক্সিজেন সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে বসানো হচ্ছে অক্সিজেন প্লান্ট। করোনার নমুনা পরীক্ষায় স্থাপন করা হচ্ছে আরো একটি বায়োসেফটি (লেভেল-৩) আরটিপিসিআর ল্যাব। আজ রোববার থেকেই এই আইসিইউ, অক্সিজেন প্লান্ট ও ল্যাব স্থাপনের কাজ শুরু হচ্ছে।
বিআইটিআইডির সহযোগী অধ্যাপক ও করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. মামুনুর রশীদ আজাদীকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আইসিইউ, অক্সিজেন প্লান্ট ও ল্যাব স্থাপনের বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সংক্রান্ত চিঠি পেয়েছি। শনিবার (গতকাল) গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীর নেতৃত্বে চারজনের একটি টিম হাসপাতালে এসেছিল। তারা সবকিছু দেখে গেছেন। রোববার (আজ) থেকেই কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন তারা।
গণপূর্ত বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ‘কোভিড-১৯ ইমার্জেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্যান্ডেমিক প্রিপেয়ারনেস’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় ৫ বেডের আইসিইউ, অক্সিজেন প্লান্ট ও বায়োসেফটি ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে বিআইটিআইডি হাসপাতালে। এ প্রকল্পে অর্থায়ন করছে বিশ্ব ব্যাংক।
একই প্রকল্পের আওতায় কক্সবাজার মেডিকেল কলেজে একটি আরটিপিসিআর ল্যাব এবং চট্টগ্রাম বন্দরে দুটি স্ক্রিনিং সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা। এর মধ্যে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের আরটিপিসিআর ল্যাব স্থাপনে ৫০ লাখ টাকা এবং বন্দরে দুটি স্ক্রিনিং সেন্টার স্থাপনে খরচ হবে এক কোটি টাকা। সে হিসেবে বিআইটিআইডি হাসপাতালে ৫ বেডের আইসিইউ, অক্সিজেন প্লান্ট ও বায়োসেফটি ল্যাব স্থাপনে খরচ পড়বে ২ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে বায়োসেফটি (লেভেল-৩) ল্যাব স্থাপনে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা এবং অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনে আরো ২০ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। বাকি টাকা খরচ হবে ৫ বেডের আইসিইউ স্থাপনে।
এদিকে, দ্রুত সময়ের (১৫-২০ দিনের) মধ্যে এ প্রকল্পের কাজ শেষ করতে তাগিদ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ তথ্য নিশ্চিত করে চট্টগ্রাম গণপূর্ত বিভাগ-৩ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইনুল ইসলাম আজাদীকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের তাগাদা রয়েছে। আমরাও চাই এ কাজ দ্রুত শেষ হোক। আমরা ইতোমধ্যে সেখানে (বিআইটিআইডি হাসপাতালে) গিয়ে সবকিছু বুঝে নিয়েছি। রোববার (আজ) থেকেই কাজ শুরু করে দিচ্ছি। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী ২০ দিনের মধ্যেই কাজ শেষ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মইনুল ইসলাম।
বিআইটিআইডি হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, হাসপাতালের নিচতলায় করোনা ব্লকের একটি কক্ষ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে ৫ বেডের আইসিইউ স্থাপন করা হবে। বর্তমানে ৫টি আইসিইউ শয্যা রয়েছে এ হাসপাতালে। তবে ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন প্লান্ট না থাকায় আইসিইউ সেবা দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদিও তিনটি আইসিইউ শয্যাকে এইচডিও হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালটির করোনা টিমের ফোকাল পারসন ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. মামুনুর রশীদ। তিনি জানান, এই তিনটি শয্যায় হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে রোগীকে প্রয়োজন মাফিক উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন সরবরাহ করা যায়। তবে সিলিন্ডারের মাধ্যমেই এ অক্সিজেন সেবা দেওয়া হয়ে থাকে। ভেন্টিলেটরসহ নতুন করে আইসিইউ ও অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপনের মাধ্যমে বিআইটিআইডি হাসপাতালও করোনা চিকিৎসায় স্বয়ংসম্পূর্ণের পথে এগিয়ে যাবে বলে মনে করেন তিনি।
তিনি বলেন, এখানে আইসিইউ সুবিধা না থাকায় এখন ক্রিটিক্যাল রোগী মাত্রই আইসিইউ থাকা হাসপাতালে রেফার করে দিতে হয়। আইসিইউ সুবিধা চালু হলে রোগীকে আর অন্য হাসপাতালে পাঠাতে হবে না। আর অক্সিজেন প্লান্ট হলে অক্সিজেন সরবরাহ নিয়েও কোনো ধরনের সমস্যা বা দুশ্চিন্তা থাকবে না। রোগীরা নির্বিঘ্নেই অক্সিজেন সেবা পাবে। সব মিলিয়ে চিকিৎসা সুবিধায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দৃশ্যমান হবে, যা চট্টগ্রামবাসীর জন্য অবশ্যই ভালো একটি খবর। অবশ্য, আইসিইউ পরিচালনায় প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন। যা ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও মন্ত্রণালয়কে চিঠির মাধ্যমে জানানো হয়েছে।
আরো একটি বায়োসেফটি ল্যাব : বিআইটিআইডিতে বর্তমানে যে ল্যাবটি রয়েছে, তা বায়োসেফটি লেভেল-৩ পর্যায়ের। ফ্রান্সের একটি প্রতিষ্ঠান এ ল্যাবটি স্থাপন করে দেয়। বিশেষায়িত হিসেবে যক্ষ্মা রোগের পরীক্ষা ছাড়াও প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলত ২য় তলায় স্থাপন করা এ ল্যাবে। করোনা সংক্রমণের পর চট্টগ্রামে সর্বপ্রথম এ ল্যাবেই করোনার নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ করোনার নমুনা পরীক্ষা কার্যক্রম চালুর পর থেকেই করোনার পাশাপাশি যক্ষ্মাসহ প্যাথলজি ও মাইক্রোবায়োলজিক্যাল বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলমান রয়েছে এ ল্যাবে। এখন আরো একটি বায়োসেফটি লেভেল-৩ পর্যায়ের ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে এখানে।
বিদ্যমান ল্যাবের উপরের ফ্লোরে (৩য় তলায়) দ্বিতীয় এ ল্যাবটি স্থাপন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিআইটিআইডি ল্যাবের প্রধান ডা. শাকিল আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের বিদ্যমান ল্যাবটি ফ্রান্সের একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান করে দেয়। এখন সরকারিভাবে নতুন একটি ল্যাব স্থাপন হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য অত্যন্ত ভালো একটি খবর। নতুন ল্যাবটিও হবে বায়োসেফটি লেভেল-৩ পর্যায়ের। স্থাপনের কাজ শেষ হলে করোনার নমুনা পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যক্রম নতুন ল্যাবেই পরিচালনা করা হবে। আর পুরনো ল্যাবে আগের মতোই যক্ষ্মাসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা কার্যক্রম চলবে।