নাসুম আহমেদের ওভারে ৫ ছক্কা ও ১ চারের যে তাণ্ডব চালালেন রায়ান বার্ল, ম্যাচের গতি-ধারা-চেহারা, সবই বদলে গেল তাতে। দলের জয়ের বীজও পোঁতা হয়ে গেল ওই ওভারেই। ওই ওভারের আগে প্রবল চাপে থাকা জিম্বাবুয়ে হুট করেই উদ্ভাসিত হয়ে ধাঁধিয়ে দিল বাংলাদেশকে।
হারারেতে তিন ম্যাচের সিরিজের শেষ টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশকে ১০ রানে হারিয়ে ২-১ ব্যবধানে সিরিজ জিতে নিল জিম্বাবুয়ে।
বাংলাদেশের সঙ্গে ৭টি দ্বিপাক্ষিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ খেলে জিম্বাবুয়ে সিরিজ জয়ের স্বাদ পেল প্রথমবার।
অথচ ম্যাচের বয়স যখন ১৩ ওভার, জিম্বাবুয়ে তখন ধুঁকছিল ৬৭ রানে ৬ উইকেট হারিয়ে। সেখান থেকেই ম্যাচ ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেন বার্ল। বিপর্যয়ের মধ্যে তার রানও ছিল এক সময় ১৪ বলে ৯। কিন্তু এক ওভারে ৩৪ রানসহ ৫৪ রানের ইনিংস খেলেন তিনি স্রেফ ২৮ বলে।
জিম্বাবুয়ে তাতে পেয়ে যায় ১৫৭ রানের পুঁজি। রান তাড়ায় বাংলাদেশের ইনিংস প্রত্যাশিত গতি পায়নি কখনোই। শেষ দিকে আফিফ হোসেন ও শেখ মেহেদি হাসানের সৌজন্যে কিছুটা জমে ওঠে লড়াই। তবে জয় পাওয়া হয়নি। দলের ইনিংস থেমে যায় ১৪৬ রানে।
বার্লের ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি আলাদা করে বলতে হবে জিম্বাবুয়ের নতুন বলের দুই বোলারের কথা। পেস আক্রমণে বড় পরিবর্তন এনে এ দিন ব্রাড ইভান্স ও ভিক্টর নিয়াউচিকে সুযোগ দেয় তারা। ম্যাচের ফলে বড় প্রভাব রাখেন দুজনই।
বাংলাদেশের দুই ওপেনারকে ফেরানোর পর শেষ দিকে শেখ মেহেদির গুরুত্বপূর্ণ উইকেট নেন নিয়াউচি। মাঝের সময়টায় টানা দুই বলে উইকেট নেন ইভান্স।
বার্লের ঝড়ের পরও এই উইকেটে ১৫৭ রান খুব বড় লক্ষ্য ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য তা দুরূহ হয়ে পড়ে শুরু থেকেই। দ্বিতীয় ওভারেই নিয়াউচিকে ফিরতি ক্যাচ দেন লিটন দাস। নিয়াউচির পরের ওভারেই সহজ ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন অভিষিক্ত পারভেজ হোসেন ইমন।
এনামুল হক ব্যর্থ আরও একটি সুযোগ কাজে লাগাতে। ওয়েসলি মাধেভেরের জোরর ওপর করা শর্ট বলে তিনি বোল্ড হন দৃষ্টিকটু শটে।
৩৪ রানে ৩ উইকেট হারানো দলকে এগিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব ছিল নাজমুল হোসেন শান্ত ও মাহমুদউল্লাহর। তারা উইকেটে কিছু সময় কাটাতে পারেন বটে, তবে রান তাড়া আগায়নি।
শান্ত শেষ পর্যন্ত ২০ বল খেলে ১৩ রান করে আউট হন উইলিয়ামসকে স্কুপ খেলে। অভিজ্ঞতার জন্য শেষ ম্যাচের দলে যুক্ত করা মাহমুদউল্লাহ প্রতিদান দিতে পারেন সামান্যই। ২৭ বল খেলে তার সংগ্রহ ২৭!
এরপর অধিনায়ক মোসাদ্দেক হোসেনও যখন বিদায় নেন প্রথম বলে বাজে শট খেলে, বাংলাদেশের আশাও সরে যায় দূরে।
এই দলে যার ব্যাটে টি-টোয়েন্টি ব্যাটিংয়ের ছাপ সবচেয়ে ধারাবাহিকভাবে দেখা যায়, সেই আফিফ হোসেনকে বিস্ময়করভাবে নামানো হয় ছয়ে। সেখান থেকেই তিনি চেষ্টা করেন। আটে নেমে শেখ মেহেদিও দ্রুত কিছু রান তোলেন। তাতে সম্ভাবনা কিছুটা উঁকি দেয় বটে। তবে শেষ দিকে ইভান্স-নিয়াউচিদের দারুণ বোলিংয়ে পেরে ওঠেনি আফিফরা।
১৭ বলে ২২ রান করে আউট হন মেহেদি, আফিফ অপরাজিত থাকেন ২৭ বলে ৩৯ করে।
ম্যাচের শুরুটা করে বাংলাদেশ টস হারের হতাশা দিয়ে। টানা তৃতীয়বার টস জিতে আবারও ব্যাটিংয়ে নামে জিম্বাবুয়ে।
জিম্বাবুয়ের ইনিংসের গঠন ছিল অদ্ভুত। শুরু করে তারা আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে। প্রথম ৩ ওভারে রান আসে ২৯। এরপর একের পর এক উইকেটের পতনে দিশা হারায় ইনিংস। পরের ১০ ওভারে উইকেট পড়ে তাদের ৬টি, রান আসে মোটে ৩৮। পরের ৫ ওভারে উইকেট নেই একটিও, রান ওঠে ৭৯!
ম্যাচের ভাগ্যও গড়া হয়ে যায় ওই সময়ে।
মুস্তাফিজুর রহমানের ফুল টসে রেজিস চাকাভার বাউন্ডারিতে শুরু হয় ম্যাচ। দ্বিতীয় ওভারে ক্রেইগ আরভিন ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে ছক্কায় ওড়ান শেখ মেহেদি হাসানকে। পরের ওভারে মোসাদ্দেক হোসেনের বলে চার-ছক্কা মারেন চাকাভা।
জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। বাংলাদেশ তাতে ভড়কে না গিয়ে রাশ টেনে ধরে দ্রুতই। নাসুম আহমেদ আক্রমণে এসেই প্রথম বলে ফেরান চাকাভাকে (১০ বলে ১৭)। এক ওভার পরই শেখ মেহেদি হাসান পরপর দুই বলে ফিরিয়ে দেন জিম্বাবুয়ের বড় দুই ভরসা ওয়েসলি মাধেভেরে ও সিকান্দার রাজাকে।
অভিজ্ঞ শন উইলিয়ামস এরপর বাজে শটে উইকেট উপহার দেন মোসাদ্দেককে। তখনও পর্যন্ত এক প্রান্ত আগলে রাখা ক্রেইগ আরভিন (২৭ বলে ২৪) স্টাম্পড হয়ে যান মাহমুদউল্লাহর প্রথম বলেই।
১০০ রানও তখন মনে হচ্ছিল জিম্বাবুয়ের জন্য বেশ দূরের পথ। কিন্তু লুক জঙ্গুয়ে উইকেটে গিয়েই প্রথম দুই বলে বাউন্ডারি মেরে পাল্টা আক্রমণের সূচনা করেন। বার্ল সেটিকে নিয়ে যান অন্য উচ্চতায়। নাসুমের এক ওভারে নেন ৩৪ রান।
টি-টোয়েন্টিতে যা জিম্বাবুয়ের হয়ে এক ওভারে সবচেয়ে বেশি রান, বাংলাদেশের সবচেয়ে খরুচে ওভার।
আরেক পাশে জঙ্গুয়ে দারুণ সঙ্গ দিতে থাকেন। শেখ মেহেদির ওভারে ছক্কা আসে দুজনের ব্যাট থেকেই। জঙ্গুয়ে ছক্কায় ওড়ান মুস্তাফিজকেও।
২০ বলে ৩৫ করে জঙ্গুয়ে আউট হন শেষের আগের ওভারে। ওই ওভারে বিদায় নেন বার্লও। কিন্তু আসল কাজ তারাই করে দিয়ে যান। বাংলাদেশ পারেনি যেটির জবাব দিতে।
ম্যাচ শেষে বাংলাদেশ অধিনায়ক মোসাদ্দেক হোসেনের সরল স্বীকারোক্তি, ‘এক ওভারেই পার্থক্য গড়া হয়ে গেছে।’ কোন ওভার, সেটি তো জানাই!
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
জিম্বাবুয়ে: ২০ ওভারে ১৫৬/৮ (চাকাভা ১৭, আরভিন ২৪, মাধেভেরে ৫, রাজা ০, উইলিয়ামস ২, শুম্বা ৪, বার্ল ৫৪, জঙ্গুয়ে ৩৫, ইভান্স ৫*, নিয়াউচি ১*; মুস্তাফিজ ৪-০-২২-১, মেহেদি ৪-১-২৮-২, মোসাদ্দেক ৪-০-২২-১, নাসুম ২-০-৪০-১, হাসান ৪-০-২৮-২, মাহমুদউল্লাহ ২-০-৮-১)
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৪৫/৮ (লিটন ১৩, ইমন ২, এনামুল ১৪, শান্ত ১৬, মাহমুদউল্লাহ ২৭, আফিফ ৩৯*, শেখ মেহেদি ২২, হাসান ৩, ; ইভান্স ৪-০-২৬-২, নিয়াউচি ৪-০-২৯-৩, মাধেভেরে ২-০-১৪-১, রাজা ৪-০-২১-০, মাসারা ১-০-৫-০, উইলিয়ামস ২-০-১৬-১, জঙ্গুয়ে ৩-০-২৮-১)
ফল: জিম্বাবুয়ে ১০ রানে জয়ী
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে জিম্বাবুয়ে ২-১ ব্যবধানে জয়ী
ম্যান অব দা ম্যাচ: রায়ার্ন বার্ল
ম্যান অব দা সিরিজ: সিকান্দার রাজা