রাশিয়ার তেল, গ্যাস ও কয়লা আমদানির ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গতকাল মঙ্গলবার (৮ মার্চ) হোয়াইট হাউজে এক সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন বলে জানায় আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
তিনি বলেন, “আমরা রাশিয়া থেকে তেল এবং গ্যাসসহ সব ধরনের জ্বালানি পণ্য আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছি। এর অর্থ যুক্তরাষ্ট্রের বন্দরগুলো আর রাশিয়ার তেল ঢুকতে দেবে না এবং আমেরিকার জনগণ পুতিনের যুদ্ধ মেশিনে আরেকটি শক্তিশালী আঘাত করবে।”
বাইডেনের এই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ববাজারে তেলের দাম ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়ে ব্যারেল প্রতি প্রায় ১৩০ মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে।
বাইডেন এ বিষয়ে তার ইউরোপীয় মিত্র দেশেগুলোর সঙ্গে একজোট হয়ে কাজ করছেন কিন্তু ইউরোপের জন্য রাশিয়ার তেল ও গ্যাসের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কঠিন কারণ তারা রাশিয়ার তেল-গ্যাসের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল।
বাইডেনের নিষেধাজ্ঞা আরোপের ঘোষণার কিছুক্ষণ আগেই যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, তার দেশ এ বছরের শেষ নাগাদ পর্যায়ক্রমে রাশিয়ার তেল এবং তেলজাত পণ্য আমদানি কমিয়ে আনতে শুরু করবে।
‘এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিসট্রেশন’-এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্র ২০২১ সালে প্রতি মাসে গড়ে রাশিয়া থেকে দুই কোটি ৪০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল এবং পরিশোধিত তেলজাত পণ্য আমাদানি করেছে যা যুক্তরাষ্ট্রের মোট তরল জ্বালানি আমদানির ৮ শতাংশ।
বাইডেন প্রশাসনের এই সিদ্ধান্তের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের মূল্য আকাশ ছুঁতে পারে। তারপরও রাশিয়ার বিরুদ্ধে তার এ ব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে সব দলের সমর্থন পেয়েছে।
বাইডেন বলেন, “ধারণা করছি, ‘পুতিন যুদ্ধের’ কারণে কিছু কিছু জিনিসের দাম আরো বাড়বে।”
আমেরিকার জনগণের ওপর তার প্রভাব যেন সর্বনিম্ন থাকে তা নিশ্চিতে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্যাস কোম্পানিগুলোকে সতর্ক করে বলেছেন, “বর্তমান পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে যদি কেউ বেশি মুনাফা লাভের আশায় অতিরিক্ত মূল্য বৃদ্ধি করে তবে তার কঠোর মূল্য দিতে হবে।”
যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর ক্রিস কন্স বলেন, “বাইডেন প্রশাসন ইউরোপের মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছে এবং ‘নিশ্চিত করতে চাইছে যে, রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর কতটা কার্যকরভাবে এই নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করা যায় সেটা বুঝতে আমরা তৃণমূল পর্যায়ে কাজ করেছি।”
তিনি যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া ভিত্তিক বার্তা সংস্থা সিএনএনকে বলেন, “এখানে যুক্তরাষ্ট্রে গ্যাসের দাম বাড়তে যাচ্ছে। ইউরোপেও দাম নাটকীয়ভাবে বাড়বে। এটাই স্বাধীনতার পক্ষে এবং ইউক্রেনের জনগণের পক্ষে দাঁড়ানোর মূল্য। আমাদেরও এই মূল্য চুকাতে হচ্ছে।”
ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য এখনই যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছে না কারণ তারা তাদের গ্যাসের ৪০ শতাংশ এবং তেলের ৩০ শতাংশের যোগান পায় রাশিয়া থেকে। এই সরবরাহ হঠাৎ বন্ধ করা হলে সহসাই কোনো বিকল্প উৎস থেকে যোগান দেওয়া সম্ভব নয়।
রাশিয়াও সেটা ভালো করেই জানে। তাই তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন(ইইউ)কে এটা নিয়ে হুমকি দিয়ে বসে আছে। বলেছে, যদি ইইউ রাশিয়ার তেল আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে তবে তারা সেখানে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেবে।
রুশ উপ-প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে এক বক্তৃতায় বলেছেন, “ইউরোপের পক্ষে রাশিয়ার তেলের একটি বিকল্প ক্ষেত্র দ্রুত খুঁজে বের করা অসম্ভব। এটা করতে অনেক সময় দরকার এবং ইউরোপের ভোক্তাদের জন্য এটা অনেক বেশি ব্যয়সাপেক্ষ হবে। শেষ পর্যন্ত, এর ফলাফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাই।”
রাশিয়া বিশ্বের শীর্ষ প্রাকৃতিক গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ, ক্রুড অয়েল বা অপরিশোধিত তেল উৎপাদনে তাদের অবস্থান দ্বিতীয়। জ্বালানি খাতে কোনো ধরনের অবরোধ আরোপ করা হলে তা সেদেশের অর্থনীতিকে দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
অক্সফোর্ড ইনস্টিটিউট ফর এনার্জি স্টাডিজ গত সপ্তাহে জানিয়েছে, ২০২১ সালে বিশ্বের মোট তেলের ১৪ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে। রাশিয়ার মোট তেল রপ্তানির ৬০ শতাংশ যায় ইউরোপে। ৩৫ শতাংশ যায় এশিয়ায়।
তেল কিনতে ইউরোপ রাশিয়াকে প্রতিদিন তিন হাজার ২৭০ কোটি টাকা দিচ্ছে বলে জানান বিশেষজ্ঞরা।
জার্মানির প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির ৩৮ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে।
সোমবার এক বিবৃতিতে জার্মান চ্যান্সেলর ওলফ শলৎস বলেন, “মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর নিষেধাজ্ঞার পক্ষে বার্লিন কিন্তু ইউরোপে প্রতিদিনের জীবনযাপনে এখনও রাশিয়ার জ্বালানি সরবরাহ ‘প্রয়োজন’৷ ইউরোপে ঘর গরম রাখতে, পরিবহন ও শিল্প খাতে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানি এই মুহূর্তে অন্য জায়গা থেকে পাওয়া সম্ভব নয়।”
ইউরোপের দেশগুলো বলেছে, তারা ধীরে ধীরে রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর এই নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে চায়। বেশ কিছু পশ্চিমা কোম্পানি এরইমধ্যে রাশিয়ার জ্বালানি কোম্পানি থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহার এবং রাশিয়া থেকে পণ্য পরিবহন বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এ ধরনের অবরোধ আরোপের জন্য পশ্চিমা বিশ্বের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছে ইউক্রেন কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই উদ্বেগ রয়েছে কারণ সেরকম পদক্ষেপ নেওয়া হলে আন্তর্জাতিক বাজারে তার প্রভাব হবে ব্যাপক।
এমন অবরোধ আরোপের শঙ্কায় সোমবার এক পর্যায়ে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম ব্যারেল প্রতি ১৩৯ ডলারে পৌঁছে যায় যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। যুক্তরাজ্যেও পেট্রোলের গড় দাম লিটার প্রতি রেকর্ড ১৫৫ পেনিতে পৌঁছেছে।