বাংলাদেশী পরিচয়ে বিদেশ যাওয়ার সময় গত শুক্রবার (১০ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন রোহিঙ্গা যুবক আসাদউল্লাহ। বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে তার সৌদি আরবের জেদ্দা যাবার কথা ছিল।
জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ভিসা সব প্রক্রিয়া শেষে বিমানবন্দরে পৌঁছে শেষে গ্রেফতার হওয়ায় আর যাওয়া হয়নি তার।
তাকে গ্রেফতারের পর তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে চট্টগ্রামের ঠিকানা ব্যবহার করে পাসপোর্ট তৈরি করেন ওই রোহিঙ্গা যুবক। তার কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) যেমন রয়েছে তেমনি ওই পরিচয়পত্র ব্যবহার করে কোভিডের টিকা নেওয়ার সনদও ছিল।
গ্রেফতার রোহিঙ্গা যুবক আসাদউল্লাহ কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছেন তা তদন্ত করছেন চট্টগ্রামের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
পাসপোর্ট অফিসে না গিয়েই দালালের মাধ্যমে তা বানানোর দাবি করেছেন ওই যুবক বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) নিহাদ আদনান তাইয়ান।
তিনি বলেন, “আসাদউল্লাহর বড় ভাই সৌদি প্রবাসী। ওমরাহ ভিসা নিয়ে তিনি সেখানে পালিয়ে যাচ্ছিলেন।”
তার নামে গত অক্টোবরে জাতীয় পরিচয়পত্র, ডিসেম্বরে পাসপোর্ট এবং ৪ ফেব্রুয়ারি ভিসা ইস্যু হয়েছে।
গোয়েন্দারা জানান, আসাদউল্লাহ পাসপোর্টে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ঠিকানা ব্যবহার করেছেন। আর জরুরি যোগাযোগে স্ত্রীর নাম দিয়ে চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানার ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছে যেগুলো ছিল ভুয়া।
পাসপোর্টে আসাদউল্লাহ তার বাবার নাম উল্লেখ করেছেন মমতাজুল হক, মায়ের নাম দিয়েছেন আমেনা খাতুন। তার রোহিঙ্গা নিবন্ধন কার্ডে বাবার নাম মো. কাছিস ও মায়ের নাম উল্লেখ করা হয়েছে শাহেরা খাতুন। তবে জিজ্ঞাসাবাদে সেগুলো ভুয়া বলে দাবি করেন আসাদউল্লাহ।
আসাদউল্লাহ থাকেন কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার থাইংখালী ১২ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। গত ৯ জানুয়ারি ক্যাম্পে সংঘটিত একটি হত্যা মামলার ‘সন্দিগ্ধ’ আসামিও তিনি বলে জানান গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিহাদ।
এজন্য তাকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। আর তার কাছ থেকে জব্দ পাসপোর্ট, জাতীয় পরিচয়পত্রসহ বিভিন্ন প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের বিষয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তদন্ত করছে।
আসাদউল্লাহ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের জানান, ২০১৭ সালে স্ত্রী ও চার সন্তান নিয়ে তিনি বাংলাদেশে আসেন। উখিয়া উপজেলার থাইংখালী ১২ নম্বর ক্যাম্পে থাকেন। ছোট বেলায় তার বাবা-মা মারা গেছেন এবং তার বড় ভাই দীর্ঘদিন ধরে সৌদি আরবে থাকেন।
তার দাবি, সৌদি আরব যাবার জন্য ২ লাখ ১০ হাজার টাকার বিনিময়ে এক ব্যক্তি তাকে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট এবং সৌদি আববের ওমরাহ ভিসা সংগ্রহ করে দিয়েছিল। কীভাবে কী হয়েছে সেটা তিনি কিছুই জানেন না।
বর্তমানে ই-পাসপোর্টের আবেদনকারীকে উপস্থিত থেকে ছবি তোলা, আঙ্গুলের ছাপ, আইরিশ প্রদান করতে হয়। নতুন পাসপোর্টের আবেদন করলে পুলিশের তদন্তসাপেক্ষে আবেদনকারীকে পাসপোর্ট বিতরণ করা হয়।
রোহিঙ্গা হওয়ার পরও তার বাংলাদেশী পাসপোর্ট ও জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার বিষয়ে গোয়েন্দা কর্মকর্তা নিহাদ বলেন, “আসাদউল্লাহ দাবি করেছেন আগে তিনি কখনও চট্টগ্রাম আসেননি । এমনকি পাসপোর্টের জন্যও আসেননি। যে দালালের সাথে তার ‘কন্ট্রাক্ট’ হয়েছিল সেই ব্যক্তিই তাকে সবকিছু তৈরি করে পৌঁছে দিয়েছেন। পাসপোর্ট অফিসে না গিয়েও কীভাবে পাসপোর্ট তৈরি করেছেন কিংবা আদৌ সেটি সম্ভব কি না সেটা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পাশাপাশি যে দালালের মাধ্যেমে পাসপোর্ট ও ভিসা করিয়েছেন তাকে শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।”
আসাদউল্লাহর কাছ থেকে জব্দ করা পাসপোর্টের সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, পাসপোর্টে তার স্থায়ী ঠিকানা চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার শোভনদণ্ডী ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের লাওয়ারখিল গ্রাম। জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে স্ত্রীর নাম শাহনাজ। ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে নগরীর ডবলমুরিং থানার বার কোয়ার্টার ৭ নম্বর গলি।
গত বছরের ২০ অক্টোবর তিনি ১০ বছর মেয়াদী ই-পাসপোর্টের আবেদন করেন এবং ৮ ডিসেম্বর তার পাসপোর্ট ইস্যু হয়। তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হবে ২০৩২ সালের ২৬ নভেম্বর।
২০২২ সালের ১০ অক্টোবর ইস্যু করা জাতীয় পরিচয়পত্রে চট্টগ্রাম নগরীর ডবলমুরিং থানার একটি বাসার ঠিকানা রয়েছে। জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যেই পাসপোর্টের আবেদন করেছেন ওই যুবক।
চট্টগ্রামের দুইটি আঞ্চলিক পাসপোর্ট কার্যালয়ের মধ্যে আসাদউল্লাহ চান্দগাঁও (পাঁচলাইশ) কার্যালয়ে পাসপোর্টের আবেদন করেন।
এ কার্যালয়ের উপ-পরিচালক তারিক সালমান বলেন, “পাসপোর্ট কার্যালয়ে না গিয়ে কোনোভাবেই পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব নয়। আঙ্গুলের ছাপ, আইরিশ প্রদান করতে হয় যেগুলো অন্যজনের মাধ্যমে কোনোভাবেই সম্ভব নয়।”
অপরদিকে, ই পাসপোর্টের আবেদনের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র বেশি প্রয়োজন জানিয়ে তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে পাসপোর্টের আবেদন করা হলে সেগুলো সব সার্ভার থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করে নেওয়া হয়। আর পুলিশ প্রতিবেদন ছাড়া কোনোভাবেই পাসপোর্ট পাওয়া সম্ভব নয়।”