কক্সবাজারে শিবিরে বসবাসরত রোহিঙ্গারা বৈধভাবে বাংলাদেশী মোবাইল ফোন নেটওয়ার্ক ব্যবহার করতে পারবে। তবে তারা কিনতে পারবে শুধু সরকারি অপারেটর টেলিটকের সিম।
মাদকসহ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ রোধে কক্সবাজারের শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত এসব নাগরিকদের কাছে টেলিটকের সিম বিক্রির সিদ্ধান্তের সুপারিশ করেছে এ সংক্রান্ত একটি কমিটি।
ইউনাইটেড ন্যাশনস হাই কমিশনার ফর রিফুইজিস (ইউএনএইচসিআর)-এর দেওয়া পরিচয়পত্রের বিপরীতে একটি রোহিঙ্গা পরিবারের সদস্যদের কাছে শুধু একটি মোবাইল সিম বিক্রির কথা বলেছে কমিটি।
তবে প্রাথমিকভাবে এমন সিদ্ধান্তের সুপারিশ করা হলেও তা চূড়ান্তের পর বাস্তবায়নে আরও সময় লাগবে বলে মনে করছেন ওই কমিটির সভাপতি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব আবু হেনা মোস্তাফা জামান।
নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কাছে বাংলাদেশী সিম বিক্রি নিষিদ্ধ হলেও তাদের অনেকে অবৈধভাবে বিভিন্ন মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম সংগ্রহ করে এ দেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবহার করছে।
পাশাপাশি সীমান্তবর্তী শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের নেটওয়ার্ক থাকায় অনেক চক্র মোবাইল ফোনে ওপারেও যোগাযোগ রেখে মাদক কারবারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এমন প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা শিবিরে ‘মোবাইল ফোনের সিম বিক্রি সংক্রান্ত সুপারিশ প্রণয়ন কমিটি’র প্রথম সভায় শুধু টেলিটকের সিম বিক্রি করার বিষয়ে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত হয় বলে জানান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব আবু হেনা।
প্রায় এক মাস আগে গত ২৮ মার্চের সভায় এ সিদ্ধান্ত হলেও এখনও কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে জানান তিনি।
শুধু টেলিটকের সিম বিক্রির সুযোগ দেওয়া প্রসঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ সব কিছু বুঝেই সিদ্ধান্ত নিতেই পারে।”
এ বিষয়ে একটি বেসরকারি মোবাইল ফোন অপারেটরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা অন্য অপারেটরদের সিম বিক্রির সুযোগ দিয়ে সব জায়গায় প্রতিযোগিতা বজায় রাখার নীতির বাস্তবায়ন চান।
রোহিঙ্গাদের হাতে বাংলাদেশী মোবাইল সিম দেওয়ার বিষয়ে গঠিত সুপারিশ কমিটির ওই সভার সভাপতি আবু হেনা বলেন, “কেবল একটি মিটিং হয়েছে। আমাদের আরও বেশ কয়েকটি মিটিং করার প্রয়োজন রয়েছে। আইনের বিষয় রয়েছে। সব কিছু বিবেচনা করেই কাজ করতে হবে। সবার মতামত নিয়ে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কাজ করব। তবে তা সময় লাগবে।”
কত সময় লাগতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সভা করে মতামত নিতে সময় লাগবে। নির্ধারিতভাবে সময় বলা মুশকিল।”
সুপারিশ প্রণয়ন কমিটির প্রথম সভায় পুলিশ সদর দপ্তর, পুলিশের বিশেষ শাখা-এসবি, গোয়েন্দা সংস্থা, শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়, বিটিআরসি, ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি), আইন ও বিচার বিভাগ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন।
রোহিঙ্গা শিবিরে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের কাছে ইউএনএইচসিআর-এর দেওয়া আইডি কার্ডের বিপরীতে প্রাথমিকভাবে টেলিটকের সিম বিক্রির অনুমতি প্রদানের বিষয়ে বিদ্যমান আইন ও বিধি সংশোধন এবং সার্বিক বিষয় যাচাই করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দিতে ১০ সদস্যের এ কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির প্রথম ওই সভায় পুলিশ সদর দপ্তরের প্রতিনিধি জানান, রোহিঙ্গা শিবিরে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকরা বর্তমানে একইসঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দুই থেকে তিনটি অপরেটরের সিম ব্যবহার করছে। জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া বাংলাদেশের সিম নিবন্ধনের সুযোগ না থাকায় তারা স্থানীয় জনগণের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করছে।
তিনি জানান, তারা মাদক কারবার, অপহরণ, মানবপাচারসহ বিভিন্ন কাজে মোবাইল ফোন ব্যবহার করে। অন্যদেশের মোবাইল অপারেটরগুলোর সিম ব্যবহার করায় তাদের গতিবিধিতে নজর রাখা এদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য কষ্টসাধ্য।
এজন্য মিয়ানমারের সিম ব্যবহার বন্ধের পরামর্শ দেন তিনি।
সভায় শিবিরগুলোতে মিয়ানমারের অপারেটরের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী বলে জানানো হয় গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে।
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রতিনিধি জানান, ইউএনএইচসিআর এ পর্যন্ত ৯ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গার ডাটাবেজ তৈরি করেছে। তবে এ ডাটাবেজ ব্যবহার করে সিম কার্ড দিতে গেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ইউএনএইচসিআর-এর সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
এদিকে, সীমান্তে ‘জ্যামার’ বসিয়ে অপর কোনো দেশের নেটওয়ার্ক বন্ধ করা প্রায় অসম্ভব মত দিয়ে বিটিআরসি’র প্রতিনিধি বিকল্প হিসেবে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ককে সেখানে শক্তিশালী করার পাশাপাশি নির্দিষ্ট সিরিজের নম্বর ব্যবহারের কথা বলেন।
আলোচনা শেষে সভায় টেলিটক সিম বিক্রির সুপারিশ করার নিদ্ধান্ত নেওয়ার পাশপাশি পরিবার প্রতি একটি করে সিম বিক্রির সুপারিশ প্রদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
এ বিষয়ে বাংলালিংকের চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স অফিসার তাইমুর রহমান জানান, তারা এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনলেও আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি পাননি।
তাদের কেন চিঠি দেওয়া হবে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “ওই এলাকায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক চলছে। একক কোনো নেটওয়ার্ক চলার সিদ্ধান্ত হলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে চিঠি দিয়ে তা জানানোর কথা। আমরা এখন সেভাবে কোনো মন্তব্য করতে পারছি না। তবে আমরা চাই যে একটা কমপিটিশন সব জায়গায় থাকুক।”
ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, “সিদ্ধান্ত তো টেলিটক নেয়নি-বিটিআরসি নেয়নি। সিদ্ধান্ত নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। জননিরাপত্তা সব কিছু বুঝেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। টেলিটক একটি সরকারি কোম্পানি। সরকার যদি নির্দেশ দেয় টেলিটক সেই নির্দেশ পালন করবে। এর সাথে কমপিটিটর অথবা কে আছে-নাই, এগুলো দেখার কোনো বিষয় না। এগুলো দেখার বিষয় হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণায়লয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের।”
টেলিটকের কাছে সরকার কোনো সেবা চাইলে তা অপারেটরটি যেকোনো মূল্যে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবে বলে জানান তিনি।