দুই বছর পর খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গড়ে ৫ শতাংশ বাড়িয়েছে সরকার। এতে ইউনিটপ্রতি দাম বাড়বে ৩৫ পয়সা।
নতুন এ দর জানুয়ারি থেকে কার্যকর করার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। এর ফলে খুচরায় গ্রাহক পর্যায়ে গড়ে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম দাঁড়াবে ৭ টাকা ৪৮ পয়সা।
আজ বৃহস্পতিবার (১২ জানুয়ারি) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গড়ে ৫ শতাংশ হারে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর কথা জানিয়েছেন।
এদিন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিদ্যুতের নতুন দর বিভিন্ন গ্রাহক শ্রেণি অনুযায়ী বাড়ানো হয়।
জ্বালানি খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসি গত ৮ জানুয়ারি গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়াতে গণশুনানি করলেও এবার দাম বাড়ানো হয়েছে সরকারের নির্বাহী আদেশে।
পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণার এক মাসের মধ্যে খুচরায় গ্রাহক পর্যায়ে দাম বাড়ানোর ঘোষণা এলো।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কারিগরি কমিটি বিতরণ কোম্পানিগুলোর দাম বাড়ানোর আবেদনের ভিত্তিতে ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বা ইউনিটপ্রতি এক টাকা ২১ পয়সা বাড়ানোর সুপারিশ করলেও সরকার ভারিত গড়ে দাম বাড়াল ৩৫ পয়সা বা ৫ শতাংশ।
তবে শুনানিতে ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন ক্যাব বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর বিরোধিতা করেছিল।
ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকেও দাম না বাড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতে অপচয় কমানো পরামর্শ এসেছিল। এ নিয়ে আলোচনার মধ্যে নতুন দরের প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
এতদিন গণশুনানির পর বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে আসলেও সরকার নিজেই দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। এজন্য আইন সংশোধন করে অধ্যাদেশ জারি করা হয়।
নতুন দর অনুযায়ী সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম আগের ভারিত গড় ৭ টাকা ১৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭ টাকা ৪৮ পয়সা।
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির পর এবার বর্ধিত দর অনুযায়ী একজন গ্রাহক এখন লাইফলাইনে (৫০ ইউনিট পর্যন্ত ব্যবহার) বিদ্যুৎ ব্যবহারের জন্য ইউনিটপ্রতি দেবেন সর্বনিম্ন ৩ টাকা ৯৪ পয়সা। আর প্রতি ইউনিটে সর্বোচ্চ ১৬ টাকা ৮০ পয়সা দিতে হবে অস্থায়ী বাণিজ্যিক বা অফিসে বিদ্যুৎ খরচের জন্য।
দাম বাড়ানোর নতুন প্রজ্ঞাপনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, বিদ্যুতে লাইফ লাইনে বা সর্বনিম্ন রেটের যারা আছেন তাদের ক্ষেত্রে ১৯ পয়সা মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে। আর সার্বিকভাবে গড়ে ৫ শতাংশ বেড়েছে।
“বিইআরসি শুনানি করে ১৫ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল। আমি মনে করি ১৫ শতাংশ খুব বেশি হয়ে যায়। এটা খুবই সামান্য মূল্যবৃদ্ধি। হয়ত দেখা যাবে লাইফ লাইন গ্রাহকদেরকে বছর শেষে অতিরিক্ত ৮০ টাকা বেশি দিতে হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।
এ প্রজ্ঞাপনের ফলে গত ৮ জানুয়ারি বিইআরসি শুনানি করে বিদ্যুতের মূল্য পরিবর্তনের উদ্যোগ নিলেও সেটি কার্যত অপ্রয়োজনীয় হয়ে গেল।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, “আমরা প্রতিমাসে একটা সমন্বয়ে যাব, পাশের দেশ যেভাবে করছে। এনার্জি প্রাইসের ওপর ভিত্তি করে কাজটি করা হবে। এলপিজির দাম এখন যেভাবে নির্ধারণ করা হয়েছে সেভাবেই আমরা করার চেষ্টা করব।”
এর আগে ভর্তুকির ভার কমাতে ২০২২ সালের গত ২১ নভেম্বর পাইকারিতে বিদ্যুতের দাম ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি)। এর ফলে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর কাছে বিক্রি করছে ৬ টাকা ২০ পয়সা, যা আগে ৫ টাকা ১৭ পয়সা ছিল।
সবশেষ খুচরায় বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল দুই বছর আগে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি। গণশুনানির প্রক্রিয়া পেরিয়ে তখন সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসি বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছিল। সেবারও দুই বছরের বেশি সময় পর বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছিল। সেসময় একইসঙ্গে পাইকারি, খুচরা ও সঞ্চালন- তিন ক্ষেত্রেই দাম বাড়িয়েছিল সরকার।
তখন পাইকারিতে দাম ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বাড়ানোর পাশাপাশি সাধারণ গ্রাহক পর্যায়ে (খুচরা) বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। এতে খুচরায় প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বেড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা হয়।
খুচরা পর্যায়ে ডিমান্ড চার্জও বিভিন্ন পর্যায়ে ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
একই সঙ্গে বিদ্যুৎ সম্পর্কিত বিভিন্ন সেবার জন্য নির্ধারিত চার্জ ও ফি এর বেশির ভাগ অপরিবর্তিত থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে তা বাড়ানো হয়েছে। নতুন কিছু সেবাও সংযুক্ত করে সেগুলোর চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, টেবির ২ এ উল্লেখ করা ফি বা চার্জের বাইরে কোনো কোনো ফি বা চার্জ আরোপ করা যাবে না।
প্রজ্ঞাপনে বিদ্যুৎ সরবরাহের নিম্ন, মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চ চাপ অনুযায়ী বিভিন্ন গ্রাহক শ্রেণির বিদ্যুতের মূল্য (এনার্জি রেট বা চার্জ) নির্ধারণ করা হয়েছে। এর সঙ্গে গ্রাহককে শ্রেণি অনুযায়ী প্রতিটি সংযোগের বিপরীতে ডিমান্ড রেট এবং মোট বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হয়।
চাপ অনুযায়ী আবাসিক, সেচ বা কৃষিকাজে ব্যবহার করা পাম্প, ক্ষুদ্র শিল্প, নির্মাণ, শিক্ষা, ধর্মীয় ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল, ব্যাটারি চার্জিং স্টেশন, বাণিজ্যিক ও অফিস, শিল্প গ্রাহক শ্রেণিতে নতুন হার নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রজ্ঞাপনে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম সর্বনিম্ন ৩ টাকা ৯৪ পয়সা এবং সর্বোচ্চ ১৬ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সর্বনিম্ন দর দেবেন নিম্ন চাপ (এলটি, ২৩০/৪০০ ভোল্ট) এ আবাসিকের ক্ষেত্রে লাইফ লাইনের (৫০ ইউনিট পর্যন্ত) ব্যবহারকারীরা। এক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটের (কিলোওয়াট/ঘণ্টা) দাম বাড়ানো হয়েছে ১৯ পয়সা; আগের দর ছিল ৩ টাকা ৭৫ পয়সা।
অপরদিকে ইউনিটপ্রতি সর্বোচ্চ দর দেবেন নিম্নচাপে বাণিজ্যিক ও অফিস হিসেবে নেওয়া অস্থায়ী সংযোগের জন্য। এক্ষেত্রে প্রতি ইউনিটে বেড়েছে ৮০ পয়সা। আগে এ দর ছিল ১৬ টাকা।
নিম্ন চাপের আবাসিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে বেশি সাধারণ ৭৫ থেকে ৩০০ ইউনিট পর্যন্ত বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়ে থাকে। এসব গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ ব্যবহার হলে প্রতি ইউনিটের দর হবে ৪ টাকা ৪০ পয়সা (আগে ৪ টাকা ১৯ পয়সা); ৭৬ থেকে ২০০ ইউনিট হলে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ০১ পয়সা (৫ টাকা ৭২ পয়সা); ২০১ থেকে ৩০০ ইউনিট হলে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৩০ পয়সা (৬ টাকা)।
এর বাইরে আবাসিকে বেশি বিদ্যুৎ ব্যবহারকারীরা ৩০১ থেকে ৪০০ ইউনিট হলে প্রতি ইউনিট ৬ টাকা ৬৬ পয়সা (৬ টাকা ৩৪ পয়সা); ৪০১ থেকে ৬০০ ইউনিট ১০ টাকা ৪৪ পয়সা (৯ টাকা ৯৪ পয়সা) এবং ৬০০ ইউনিটের ঊর্ধ্বে ১২ টাকা ০৩ পয়সা (১১ টাকা ৪৬ পয়সা) করা হয়েছে।
নতুন মূল্যহারে সেচ বা কৃষি কাজের জন্য ব্যবহৃত পাম্পের বিদ্যুতের জন্য দিতে হবে ৪ টাকা ৩৭ পয়সা। এক্ষেত্রে আগের দর ৪ টাকা ১৬ থেকে বাড়ানো হয়েছে ২১ পয়সা।
ক্ষুদ্র শিল্পে ফ্যাট রেট করা হয়েছে ৮ টাকা ৯৬ পয়সা (আগে ৮ টাকা ৫৩ পয়সা); অফ পিকে ৮ টাকা ০৬ পয়সা (৭ টাকা ৬৮ পয়সা) এবং পিক আওয়ারে ইউনিটপ্রতি দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা ৭৫ পয়সা (১০ টাকা ২৪ পয়সা)।
বাণিজ্যিক ও অফিসের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাট রেট ১০ টাকা ৮২ পয়সা (আগে ১০ টাকা ৩০ পয়সা); অফপিক ৯ টাকা ৭৩ পয়সা (৯ টাকা ২৭ পয়সা) এবং পিক ১২ টাকা ৯৮ পয়সা (১২ টাকা ৩৬ পয়সা)।
এছাড়া মধ্যম, উচ্চ ও অতি উচ্চ চাপে এসব শ্রেণির গ্রাহকদের প্রতি ইউনিটের জন্য আরও বেশি টাকা গুনতে হবে।
অপরদিকে উচ্চ চাপে শিল্পের জন্য ফ্ল্যাট রেট ধরা হয়েছে ৮ টাকা ৮৭ পয়সা (আগে ছিল ৮ টাকা ৪৫ পয়সা), অফি পিকে ৭ টাকা ৯৯ পয়সা (৭ টাকা ৬১ পয়সা) এবং পিক আওয়ারে ১১ টাকা ০৯ পয়সা (১০ টাকা ৫৬ পয়সা)।