ছবি তোলাতে এসে ধরা ২ রোহিঙ্গা

লাখ টাকার বিনিময়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি

আজাদী অনলাইন | বুধবার , ২৬ অক্টোবর, ২০২২ at ৮:৩৭ অপরাহ্ণ

ভোটার তালিকা হালনাগাদের সুযোগ নিয়ে অবৈধভাবে জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে নিচ্ছে রোহিঙ্গারা, যেজন্য তারা বেছে নিচ্ছে মহানগর এলাকা।

চট্টগ্রামে লাখ টাকার বিনিময়ে ভোটার তালিকায় নাম লেখাতে এসে গতকাল মঙ্গলবার দুই রোহিঙ্গা, পাঁচ ডেটা এন্ট্রি অপারেটরসহ ১০ জনকে গ্রেফতারের পর গোয়েন্দা পুলিশ কর্মকর্তারা এমন সন্দেহে প্রকাশ করেন।

গ্রেফতার দুই রোহিঙ্গা হলো কামাল হোসেন (৪৫) ও পারভীন আক্তার (২৫);

ডেটা এন্ট্রি অপারেটর ইয়াছিন আরাফাত (২২), নুর নবী ওরফে অনিক (২৫), মিজানুর রহমান (২৩), ফরহাদুল ইসলাম (২৮) ও ইমন দাশ (২০)। গ্রেফতার অন্য তিনজন হলো নুরুল আবছার (২৮) ও শামসুর রহমান ওরফে শামসু মাস্টার (৬০) ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালক মো. কামাল (৪২)।

তাদের মধ্যে নুরুল আবছার ও শামসু মাস্টার বিভিন্ন স্থান থেকে রোহিঙ্গাদের সংগ্রহ করে ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের মাধ্যমে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র পেতে সহায়তা করে।

আর অটোরিকশা চালক কামাল দুই রোহিঙ্গাকে ভোটার হালনাগাদ কার্যক্রমের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলেন বলে জানিয়েছেন নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মোহাম্মদ আলী হোসেন।

এ বিষয়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামানের সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও তার বক্তব্য জানা যায়নি।

এর আগে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে চট্টগ্রামের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে ধরা পড়ে এক রোহিঙ্গা নারী। তারা দেখতে পান ওই রোহিঙ্গা নারীর সকল তথ্য সংরক্ষিত আছে ইসির সার্ভারে।

তরপর নড়ে চড়ে বসে নির্বাচন কমিশন। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে অনুসন্ধান চালিয়ে কমিশনের তদন্ত দল জানতে পারে, নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মচারী এবং টেকনিক্যাল সাপোর্ট ও ডেটা এন্ট্রি অপারেটরের সহযোগিতায় এই জালিয়াতি চালিয়ে আসছে ওই চক্র।

গোয়েন্দা ‍পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, গতকাল মঙ্গলবার নগরীর হালিশহর হাউজিং এস্টেট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোটার হতে ছবি তোলাতে যায় দুই রোহিঙ্গা কামাল ও পারভীন। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ তাদের আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে ডেটা এন্ট্রি অপারেটর ও দুই ‘দালালের’ বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলী হোসেন জানান, ভোটার তালিকা হালনাগাদের জন্য ছবি, আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ নেওয়া হচ্ছিল পাহাড়তলী নির্বাচন অফিসের অধীনে হালিশহর হাউজিং এস্টেট উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে। সেখানে দুই রোহিঙ্গাকে আটকের পর দায়িত্বরত ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের মধ্যে পাঁচজনের মোবাইল ফোনে বিভিন্ন ধরনের তথ্য পাওয়া যায়।

ওই কেন্দ্রে আটজন অপারেটর ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ করছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, “তাদের মধ্যে গ্রেফতার পাঁচজনই রোহিঙ্গাদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তির সঙ্গে জড়িত থাকার প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ পাঁচজনের মধ্যে অন্যতম নুর নবী।”

গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলী হোসেন বলেন, “ডেটা এন্ট্রি অপারেটররা ভোটারদের বিভিন্ন তথ্য যেমন ছবি তোলা, আঙ্গুলের ছাপ ও চোখের আইরিশ সংগ্রহ করে সার্ভারে ইনপুট দেন যে কারণে রোহিঙ্গাদের নাম তারা সহজেই যুক্ত করতে পারছেন।”

নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (বন্দর) সামীম কবির জানান, গ্রেফতার রোহিঙ্গা ও অপারেটরদের তথ্য ধরে বহদ্দারহাটে অভিযান চালিয়ে আবছার ও শমসু মাস্টারকে আটক করা হয়।

তারাই মূলত কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকায় রোহিঙ্গাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে দেওয়া থেকে শুরু করে এনআইডি করে দিতে প্রতিজনের কাছ থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা করে নেয়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, যে জন্মসনদ রোহিঙ্গাদের তৈরি করে দেওয়া হচ্ছে সেটি ‘আসল’। জন্ম নিবন্ধনটির তথ্য সার্ভারেও পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কর্মচারী এসব জন্ম নিবন্ধন তৈরি করে দেন বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে। তবে ওই কর্মচারীর বিষয়ে বিস্তারিত জানাননি তারা।

চার ধাপে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম শুরু হয়েছে গত মে মাসে। প্রথমে বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহের পর নির্ধারিত নিবন্ধন কেন্দ্রে ছবি তোলা, ১০ আঙুল ও চোখের আইরিশের ছাপ নেওয়া হচ্ছে। সব প্রক্রিয়া শেষ করে খসড়া তালিকা প্রকাশ, দাবি আপত্তি শেষে আগামী বছর মার্চে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে।

গোয়েন্দারা জানান, তথ্য সংগ্রহকারীরা তথ্য সংগ্রহ করে ভোটারদের একটি ফরম নির্বাচন অফিসে জমা দেন কিন্তু আটক দুই রোহিঙ্গার কাছ থেকে এরকম ফরম পাওয়া গেছে। এটি কীভাবে তাদের হাতে গেছে সেটিও খতিয়ে দেখা হবে।

কক্সবাজারে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভূক্তি হওয়া কষ্টকর উল্লেখ করে গোয়েন্দা কর্মকর্তা আলী হোসেন বলেন, “এ কারণে তারা দালালের মাধ্যমে চট্টগ্রাম নগরীতে চলে আসেন। আটক ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের কাছ থেকে বেশকিছু নম্বর পাওয়া গেছে। এ জালিয়াতির সাথে নির্বাচন কমিশনের কিছু কর্মচারীও জড়িত বলে তারা জানিয়েছেন কিন্তু সব বিষয় খতিয়ে দেখতে হবে।”

তিনি জানান, গ্রেফতার ডেটা এন্ট্রি অপারেটররা এর আগে বিভিন্ন কেন্দ্রে কাজ করেছেন। সেখানে তারা রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভূক্ত করেছেন কি না সেটাও খতিয়ে দেখা হবে।

গোয়েন্দারো কর্মকর্তারা জানান, রোহিঙ্গাদের টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশি জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরি করে দেওয়ার বিষয়ে প্রাইমারি স্কুলের সাবেক প্রধান শিক্ষক শমসু মাস্টার বিশ্বস্ততা অর্জন করেছেন। তিনিই বিভিন্ন স্থান থেকে রোহিঙ্গাদরে নগরীতে পাঠান।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা সামীম কবির বলেন, “কক্সবাজারের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক থাকাকালে রোহিঙ্গাদের এনআইডি তৈরিতে সহায়তার অভিযোগে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়।”

পূর্ববর্তী নিবন্ধদক্ষিণ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের মিছিলে বাধা, আটক ১০
পরবর্তী নিবন্ধবাঁশখালীর কালীপু‌রে সংঘ‌র্ষে আহত ৩