বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘নাজুক’ জানিয়ে তাকে আবার ‘দ্রুত’ বিদেশে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ড।
চিকিৎসকদের দাবি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ‘মৃত্যুঝুঁকি বেড়ে গেছে’। চিকিৎসায় দেশে যা কিছু করার, তা শেষ হয়ে এসেছে। ‘কোনো ওষুধে কাজ করবে না’, এই রকম একটা অবস্থায় চলে যেতে পারে পরিস্থিতি।
দুর্নীতির দুই মামলায় ১৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত বিএনপি নেত্রীকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে পরিবারের আবেদন সরকার একাধিকবার প্রত্যাখ্যানের মধ্যে সোমবার এভারকেয়ার হাসপাতালে সংবাদ সম্মেলনে আসেন চিকিৎসকরা।
দীর্ঘদিন ধরে আথ্রাইটিস, হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি ও ডায়াবেটিসহ নানা রোগে ভুগছেন ৭৮ বছর বয়সী বিএনপি নেত্রী।
মেডিকেল বোর্ডের পক্ষে অধ্যাপক এফএম সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, “ম্যাডামের পেটে পানি জমছে, ফুসফুসে সংক্রমণ, পেটে অল্প অল্প রক্তক্ষরণ হতে থাকে। এবার হাসপাতালে ভর্তির পর উনাকে চার ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। বাস্তব অবস্থা অত্যন্ত জটিল ও কঠিন। আমাদের এই মেডিকেল বোর্ড এবং চিকিৎসায় সম্পৃক্ত সবাই চব্বিশ ঘণ্টা উনাকে নিবিড় পর্যাবেক্ষণে রেখে চিকিৎসা চালিয়ে যাচ্ছে।”
দেশে চিকিৎসার ‘সব অপশন শেষ হয়ে এসেছে’ জানিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের হাতে কোনো অপশন নাই। যদি আমরা দুই বছর আগে টিপস (চিকিৎসার একটি পদ্ধতি) প্রসিডিউরটা করতে পারতাম, তাহলে আজকে উনার পেটে ও বুকে পানি জমা হত না, উনার পেটে কোনো রক্তক্ষরণ হত না।”
এখনও ‘সময় শেষ হয়ে যায়নি’ মন্তব্য করে এই চিকিৎসক বলেন, “এখনও সময় আছে যদি ‘টিপস’ করা হয় এবং বিদেশে উন্নত মাল্টিডিসিপ্লিনারি সেন্টারে নিয়ে উনার ‘টিপস’ পরবর্তী লিভার প্রতিস্থাপনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়, সম্ভবত এখনও আমাদের হাতে অপশন আছে যে, আমরা হয়ত উনার অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারব।
“এই ‘টিপস’ প্রসিডিউরটার কথা বলেছি, এটা ইমিডিয়েট দরকার। এই টিপস বাংলাদেশে হয় না। এটা হলে উনার বুকে যে পানি আসছে এটা চলে যাবে, রক্তক্ষরণ হবে না। এটা লাইফ সেভিংস প্রসিডিউর। এটি বাংলাদেশে হয় না। লিভার ট্রান্সপ্লান্টও বাংলাদেশে হয় না।”
বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ চেয়ে আবেদন প্রত্যাখ্যান
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় পাঁচ বছরের সাজা নিয়ে কারাগারে যাওয়া বিএনপি নেত্রীর সাজা ওই বছরের অক্টোবরের শেষে বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে হাই কোর্ট। তার আগের দিন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় তার সাজা হয় ৭ বছর।
উচ্চ আদালতে জামিনের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর ২০২০ সালের শুরুতে খালেদা জিয়ার স্বজনরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন নিয়ে যান। এরপর ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা ব্যবহার করে সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত করলে বিএনপি নেত্রী ২০২০ সালের ২৫ মার্চ মুক্তি পেয়ে বাসায় ফেরেন। এরপর সাময়িক মুক্তির মেয়াদ আবার ছয় মাস করে বাড়ানো হয় আট বার।
সেই মুক্তির দুটি শর্তের মধ্যে একটি ছিল, সাবেক প্রধানমন্ত্রী দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। তবে ২০২১ সালের শেষে পরিবারের পক্ষ থেকে তার ‘জীবন সংকটে’ জানিয়ে বিদেশে নেওয়ার জন্য সুযোগ চেয়ে আবেদন করা হয়। সে সময় বিএনপি একই দাবিতে রাজপথে টানা কর্মসূচি পালন করে।
সাবেক প্রধানমন্ত্রীর চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে তখনও বলা হয়, দেশে চিকিৎসার সব সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। বিদেশে নেওয়ার সিদ্ধান্তে দেরি হলে যে কোনো সময় যে কোনো কিছু হয়ে যেতে পারে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের পক্ষ থেকে সে সময় বক্তব্য আসে তাদের নেত্রী ‘জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে’।
সে সময় প্রায় তিন মাস হাসপাতালে থেকে খালেদা জিয়া বাসায় ফেরেন। এবার তিনি আবার হাসপাতালে এক মাস ধরে।
গত ৯ অগাস্ট হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর পরিবারের পক্ষ থেকে গত ২৫ সেপ্টেম্বর সরকারের কাছে আবার বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ চেয়ে আবেদন করা হয়। এবারও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আইনের যে বিধান ব্যবহার করে তার সাজা স্থগিত করা হয়েছে, সেটি দুইবার ব্যবহারের সুযোগ নেই।
বিদেশে যেতে চাইলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে গিয়ে আদালতে আবেদন করতে হবে অথবা রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইতে হবে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।
মেডিকেল বোর্ডের হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন
এর মধ্যে রবিবার রাতে বিএনপি নেত্রীর মেডিকেল বোর্ডের পক্ষ থেকে হঠাৎ সংবাদ সম্মেলন ডাকা হয়। এতে দেশে লিভার প্রতিস্থাপনের সুযোগ নেই বলে চিকিৎসকের পক্ষ থেকে বক্তব্য আসার পর একজন সাংবাদিক বলেন, দেশে এখন এই চিকিৎসা আছে।
জবাবে মেডিকেল বোর্ডের সদস্য গ্যাস্ট্রোলজির অধ্যাপক একেএম মহসিন বলেন, “আমাদের এখানে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয় না। এখানে একটা-দুইটা হয়েছে…বলতে পারেন যে, এক্সপেরিমেন্ট ব্যাসিসে। আমাদের এখানে লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্টের যে সেটআপ, সেই সেটআপ তৈরি হয় নাই। যে ম্যানপাওয়ার দরকার তা নেই, আমাদের কোনো সার্জারি নেই। বেগম খালেদা জিয়ার ক্রিটিক্যাল অবস্থা। বাংলাদেশে তার টিপস ও লিভার ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার মতো সেটআপ নাই।”
খালেদা জিয়ার অবস্থা ‘জটিল’ মন্তব্য করে মেডিকেল বোর্ডের প্রধান অধ্যাপক শাহাবুদ্দিন তালুকদার বলেন, “ম্যাডামকে কেবিন থেকে সিসিইউতে নেওয়া হয়েছে। কেবিন থেকে কখন একজন রোগীকে নেওয়া হয় সিসিইউতে? যখন রোগীর অবস্থা ক্রিটিক্যাল থাকে, যখন এভরি চান্স অব কলাপস, সার্টেনলি কলাপস। ম্যাডামের হৃদরোগ আছে, একটা রিং লাগানো আছে, দুইটা ব্লক আছে…যখন পানি বের করা হয় তখন চান্স অব কলাপস। সেই পানি বের করার জন্য উনাকে সেজন্য সিসিইউতে নিতে হয়েছে। এটা বাস্তবতা। আপনারা দেখতে পারছেন আগে ভর্তি হলে বাসায় যেতে পারতেন, এরপর ভর্তি হয়ে একটু বেশি সময় থেকেছেন আর এখন ভর্তি হয়ে তিনি বাসায় যেতে পারছেন না। এর থেকে আপনারা বুঝতে পারেন ম্যাডামের অবস্থাটা কোন পর্যায়ে।”
অধ্যাপক নুরউদ্দিন আহমেদ বলেন, “উনার অনেকগুলো রোগ আছে। তার মধ্যে উনি লিভার সিরোসিসের কারণে বেশি কষ্ট পাচ্ছেন। লিভার সিরোসিসের অনেক জটিলতা আছে এর মধ্যে যেমন পেটে রক্তক্ষরণ হয়েছে, এগুলো লিভার সিরোসিসের কারণে হয়েছে। উনার পেটে পানি আসা সেটাও লিভার সিরোসিসের আরেকটি জটিলতা, বুকে পানি আসা আরেকটি মারাত্মক জটিলতা। পেটের পানির কারণে ইনফেকশন হওয়া সেটাও মারাত্মক জটিলতা লিভার সিরোসিসের কারণে। যেখানে মৃত্যু ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। আল্লাহর রহমতে আমরা চিকিৎসকরা আমাদের পক্ষে যতটুকু সম্ভব হয়েছে, যার কারণে উনি হয়ত এই যাত্রা সেইভ হয়ে গেছেন। কিন্তু পেটের মধ্যে, বুকের মধ্যে যতক্ষণ পানি থাকবে ততক্ষণ মারাত্মক ইনফেকশন হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। একটা পর্যায়ে কোনো ওষুধে কাজ করবে না এই রকম অবস্থায় চলে যেতে পারে। সেই অবস্থায় মৃত্যু ঝুঁকি অনেক বেড়ে গেছে।”
দু’দিন পরই বিভিন্ন জটিলতা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “রক্তে ইনফেকশন, পানির জন্য ইনফেকশন ইত্যাদি দেখা দিচ্ছে।…উনার জন্য চিকিৎসার সুযোগ দেশে নয়, বিদেশে আছে। সেখানে উন্নত সেন্টারে নিয়ে ‘টিপস’ করলে উনার বুকে ও পেটে পানি জমা বন্ধ হতে পারে। এটা না করা গেলে এখানে যে কোনো মুহূর্তে উনার মৃত্যুঝুঁকি অত্যন্ত বেশি।”
সংবাদ সম্মেলন অধ্যাপক এসএমএ জাফর, অধ্যাপক শামসুল আরেফিন ও অধ্যাপক এজেডএম জাহিদ হোসেন উপস্থিত ছিলেন।