বিএনপি’র সমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষের মধ্যে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় করা মামলায় গ্রেফতার মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।
তাকে নেওয়া হয়েছে কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। আজ রবিবার (২৯ অক্টোবর) রাত সাড়ে দশটার দিকে কারাগারে প্রবেশ করেন তিনি।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার মাহবুবুল ইসলাম জানান, রাত ১০টা ২৯ মিনিটে কারাগারে প্রবেশ করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
রাজধানী ঢাকার মহানগর হাকিম শফি উদ্দিন আজ রবিবার রাত ১০টায় বিএনপি মহাসচিবের জামিন আবেদন নাকচ করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
ফখরুলের পক্ষে জামিন আবেদনের শুনানি করেন আইনজীবী ওমর ফারুক ফারুকী, মোসলেহ উদ্দিন জসিম, খোরশেদ আলম মিয়া, সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ, গোলাম মোস্তফা ও মহসীন মিয়া। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি আবদুল্লাহ আবু।
ফখরুলকে এ মামলায় রিমান্ডে নেওয়ার কোনো আবেদন পুলিশের পক্ষ থেকে করা হয়নি। সেই কারণে তাকে এজলাসেও তোলা হয়নি। শুনানির আধা ঘণ্টা আগে তাকে কোর্ট হাজতে রাখা হয়।
ফখরুলের আইনজীবীরা তাকে কারাগারে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দেওয়ার পাশাপাশি চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আবেদন করেছিলেন। বিচারক এ বিষয়ে কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন।
আজ রবিবার সকালে বিএনপি’র ডাকা হরতালের মধ্যে মির্জা ফখরুলকে রাজধানীতে তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। সারা দিন তাকে রাখা হয় ডিবি কর্যালয়ে।
সাংবাদিকরা সারাদিন সেখানে অপেক্ষায় ছিলেন ফখরুলকে কোন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে তা জানার জন্য। সেই তথ্য পাওয়া যায় সন্ধ্যার পর।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ কমিশনার (মিডিয়া) ফারুক হোসেন রাত সাড়ে ৮টায় সাংবাদিকদের জানান, শনিবার সংঘর্ষের সময় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনায় রমনা মডেল থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। সেই মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে বিএনপি মহাসচিবকে আদালতে পাঠানো হয়েছে।
এর কিছুক্ষণ আগে বিশেষ পুলিশ প্রহরায় একটি সাদা মাইক্রোবাসে করে গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয় থেকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে নেওয়া হয় ফখরুলকে। সেখানে তাকে হাজতখানায় রাখা হয়।
জামিন শুনানিতে ফখরুলের আইনজীবী ফারুকী বলেন, “তিনি রাজনীতিতে স্বচ্ছ ব্যক্তি, তার কোনো বদনাম নেই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষাবিদ, অনেক রকম অসুখে আক্রান্ত, ভালোভাবে হঁটতে পারেন না।”
সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ বিচারককে উদ্দেশ করে বলেন, “আদেশ কী দেবেন জানি। সেই কারণে কারাগারে তার সুচিকিৎসা আর প্রথম শ্রেণির মর্যাদার আবেদন দিয়েছি। দয়া করে বিবেচনা করবেন।”
এ কথায় রাষ্ট্রপক্ষ থেকে শোরগোল ওঠে। তারা এ কথার প্রতিবাদ করেন। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের একজন বলেন, “এখনো শুনানি শুরুই হলো না, আপনি নিজেই আদেশ দিয়ে ফেললেন!”
আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেন, এজাহারে যে ঘটনাস্থল দেখানো হয়েছে, তার দুই কিলোমিটার দূরে বিএনপি’র কার্যালয়ের সামনে মঞ্চে ছিলেন ফখরুল। অথচ বলা হচ্ছে তিনি হামলা করেছেন প্রধান বিচারপতির বাড়িতে।
তখন বিচারক বলেন, “আপনি এজাহার আর আদালতে আসামি পাঠানোর প্রতিবেদন দেখে কথা বলছেন?”
আইনজীবী ফারুকী তখন বলেন, “দেখে কথা বলছি।” পরে তিনি জামিনের অন্য যুক্তি তুলে ধরেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবীদের বক্তব্যের পর রাষ্ট্রপক্ষ যুক্তি খণ্ডন করে। আবদুল্লাহ আবু বলেন, “দূরত্ব বিষয় নয়। সশরীরে ফখরুল সাহেব উপস্থিত ছিলেন এমন কথা বলা হয়নি মামলায়। বলা হয়েছে যে তিনি নির্দেশদাতা। এমন একটি ন্যক্কারজনক ঘটনা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কথা বলে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলা, পুলিশ হত্যা, গাড়ি পোড়ানো, গুলি করা এগুলো কি শান্তির উপাদান?”
দুই পক্ষে শুনানি নিয়ে আদালত জামিন নাকচ করে আদেশ দেয়। শুনানির সময় দুই পক্ষে উত্তেজনা, বাদানুবাদ চলে। জামিন নাকচ হয়ে গেলে ফখরুলকে পাঠানো হয় কারাগারে।
জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘সরকার পতনের’ এক দফা দাবিতে শনিবার সমাবেশ ডেকেছিল বিএনপি। ২০ শর্তে তাদের সমাবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ।
শনিবার দুপুরের আগে নয়াপল্টন বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ শুরুর পর কাছেই কাকরাইল মোড়ে দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ শুরু হয়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের এলাকায়। শান্তিনগর, নয়াপল্টন, বিজয়নগর, ফকিরাপুল, আরামবাগ এবং দৈনিক বাংলা মোড় এলাকা রণক্ষেত্রে রূপ নেয়।
সংঘর্ষের মধ্যে পুলিশ বক্সে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ হাসপাতালে ঢুকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে আগুন দেওয়া হয়, ভাঙচুর অগ্নিসংযোগ করা হয় আরো ডজনখানেক যানবাহন। হামলা করা হয় প্রধান বিচারপতির বাসভবনে।
দৈনিক বাংলা মোড়ে পুলিশ কনস্টেবল আমিরুল ইসলাম পারভেজকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। সংঘাতে প্রাণ যায় যুবদলের মুগদা থানার ৭ নম্বর ওয়ার্ডের নেতা শামীম মোল্লার।
সংঘর্ষের মধ্যে পণ্ড হওয়া সমাবেশ থেকেই রবিবার সারাদেশে হরতালের ডাক দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এরপর রবিবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে তার গুলশানের বাসায় যায় গোয়েন্দা পুলিশ।
ফখরুলকে আটকের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে তার স্ত্রী রাহাত আরা বেগম পরে সাংবাদিকদের বলেন, “ওরা (পুলিশ) সকালে এলো। ওই সময় আমরা চা খাচ্ছিলাম। এসে প্রথমে বলল যে, স্যার আপনার সাথে কথা বলব। কিছু কথাবার্তা বলে নিচে চলে গেল। বলল যে, ‘স্যার আপনার সাথে কথা বলার জন্য আসছিলাম।’ যাওয়ার সময়ে তারা বাসায় ভেতরের সিসি ক্যামেরার ডিভাইস (হার্ড ডিস্ক) এবং অ্যাপার্টমেন্টের নিচের সিসি ক্যামেরার ডিভাইস নিয়ে গেছে। আমার যতটুকু ধারণা, তারা নিচেই ছিল। ১০ মিনিট পরে আবার এলো যে, ‘স্যার আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে’। যা বলে প্রত্যেকবার… ‘স্যার উপরের অর্ডার আছে’।”