পবিত্রতা ও বরকতময় শক্তির বিশ্বাসে দিল্লির প্রাচীন শহর মেহরৌলিতে উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুফি সাধক হযরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রা.) দরগায় অনেক মুসলিম শাসক, অভিজাত সমাহিত হতে চেয়েছিলেন। ফলস্বরূপ, পঞ্চদশ শতাব্দীর মধ্যে সুফি, সাধক, উলামা, শাসক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিসহ প্রায় শতাধিক সমাধিতে ভরে ওঠে ঐতিহাসিক দরগাহটি। এ ছাড়াও অনেক শাসক দরগায় গিয়েছিলেন, তাদের রাজত্ব রক্ষার প্রার্থনায়। সাধকের আত্মা খুশি হবে, বিনিময়ে ইচ্ছাপূরণ হতে পারে, এমন বিশ্বাসে তারা সমাধিসহ দরগাহ প্রাঙ্গণ সজ্জিত ও নতুন স্থাপনাও যুক্ত করেছিলেন। এসব নিদর্শনের সঙ্গে নানা আকৃতি–পরিমাপের সমাধিগুলো কমপ্লেক্সের স্থাপত্য বৈচিত্র্যই নয় বরং রঙের ছিটা যোগ করেছে, ইতোমধ্যে রঙিন কুতুব সাহেবের দরগায়। ভারতের ‘ন্যাশনাল মিশন অন মনুমেন্টস অ্যান্ড অ্যান্টিকুইটিস‘ জরীপ, মনুমেন্টস অব দিল্লি, মুসলিম সিরনি ইন ইন্ডিয়া, দিল্লি দ্য বিল্ট হেরিটেজ, মুরাক্কা–ই–দিল্লি–এর মতো বিখ্যাত সব গ্রন্থে দরগাহটির বিস্তারিত বিবরণ রয়েছে। এসবের সূত্রে আর ডায়মন্ড সিমেন্টের কাফেলায় আমার দেখার অভিজ্ঞতা মিশিয়ে দরগাহ কমপ্লেক্সের বাকি সমাধি আর নিদর্শনগুলোর আদ্যপ্রান্ত তুলে ধরছি।
পুরো দরগাহ কমপ্লেক্সটি খিলানসহ প্রবেশপথের মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি জটিল নেটওয়ার্কে যুক্ত, যা এক অংশ থেকে অন্য অংশে এবং বড় খোলা উঠান ও সমাবেশের হলগুলির দিকে নিয়ে যায়। ফুল, ঝলকানি এবং পরী–বাতি দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো কমপ্লেক্সে তিনটি মসজিদ, নহবত খানা (ঢোলঘর), মজলিস খানা (সমাবেশ হল), তোশাখানা (বস্ত্রঘর), বাওলি (জলকূপ), দেওয়ান খানা ইত্যাদি রয়েছে। এছাড়া দরগাহের লাগোয়া জাফরমহল এবং মতি মসজিদের মতো ঐতিহাসিক নিদর্শনসহ বেশ কিছু মুঘল রাজকীয় স্থাপনা রয়েছে। পশ্চিম গেট লাগোয়া জাফরমহল মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ রাজকীয় কাঠামো। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে দ্বিতীয় আকবর শাহের নির্মিত গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদটিতে তাঁর ছেলে শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর যুক্ত করেছিলেন উঁচু ও দৃষ্টিনন্দন হাতি গেট। বাঁকা বাঙ্গালদার ছাদ, সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা ঝাড়োখা জানালা আর মার্বেল ইনলেসহ লাল বেলেপাথরের রাজকীয় হাতি গেটটি তাঁর আরও বিখ্যাত গজলের মতোই একটি উত্তরাধিকার, যা জনপ্রিয় হয়ে চলেছে। দুর্ভাগ্যবশত, প্রাসাদটির খুব বেশি অবশিষ্টাংশ নেই, এটি বাড়ি এবং দোকানে রূপান্তরিত হয়েছে। কুতুব সাহেবের কবরের পশ্চিম দিকে আজমেরী গেটের বাম দিকে মতি মসজিদের অবস্থান। রাজপরিবারের সদস্যদের নিজস্ব উপাসনার স্থান হিসেবে ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের ছেলে সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহ (১৭০৭–১২) বানিয়েছিলেন। পুরো সাদা মার্বেলে তৈরি মসজিদে তিনটি চিত্তাকর্ষক গম্বুজ, তিনটি খোলা খিলান, বিস্তৃত মিহরাব ও দ্বিতল মিনার রয়েছে।
পুরো দরগাহ আর রাজকীয় স্থাপনাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর ঘনিষ্টজন, শাসক আর ভক্তদের সমাধিগুলো। কুতুব সাহেবের সমাধির একেবারে কাছেই নজরকাড়া সমাধিসৌধটি খাজা আব্দুল আজিজ বোস্তামীর। ইতিহাস বলছে, দরগার পুরো জমি আজিজ বোস্তামীর কাছ থেকে কিনেছিলেন কুতুব কাকী। তাই সাধকের সমাধির খুব কাছেই সম্মানের স্থান দেওয়া হয় ধার্মিক শেখ আজিজকেও। লোদি স্থাপত্যশৈলীতে পুরো মার্বেল পাথরের তৈরি বারো–স্তম্ভের বর্গাকার সুন্দর প্যাভিলিয়নের সমাধিসৌধ, মার্বেল বেলস্ট্রেডে ঘেরা কবরটি কাপড়ে ঢাকা। সমাধি চত্বর থেকে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে একটি কক্ষে দেখলাম কাজী হামিদুদ্দিন নাগোরীর সমাধি। তিনি কুতুব সাহেবের শিক্ষক, কোরআন শিক্ষা দিয়েছিলেন। ইতিহাস বলছে, সোহরাওয়ার্দী তরিকার সুফি সাধক হামিদুদ্দিন নাগোরী প্রথম জীবনে বোখারার রাজপুত্র এবং পরে রাজা হন। কথিত আছে, স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি তপস্বী জীবন বেছে নিয়েছিলেন। তিনি তিন বছর নাগৌরের কাজীর দায়িত্বে ছিলেন। সরকারি অবস্থান থাকা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন সামার (ধর্মীয় সংগীত) সমর্থক, ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথাটিকে জনপ্রিয় করার জন্য জোরালো ভূমিকা রাখেন। ৬৪৩ হিজরির ৯ রমজানে তারাবীহ নামাজের সেজদা অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। শায়খ হামিদুদ্দিন নাগৌরী নামে আরেকজন প্রখ্যাত সুফি ছিলেন যিনি শেখ শিহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর সবচেয়ে পণ্ডিত খলিফা এবং খাজা মুইনুদ্দিন চিশতির কাছের শিষ্যও ছিলেন। তাঁর সমাধি নাগৌরে (জয়পুর)।
এরপর গেলাম মহিলাদের একটি সমাধিতে, মামলুক স্থাপত্য শৈলীর সাদা সবুজ বর্ণে মিশ্রণের সুন্দর ছোট ঘেরে দুটি কবর। একটি কুতুব সাহেবের দাইজি বিবি হাম্বলের, অন্যটি সাধকের মা বা স্ত্রীর বলা হয়। ঘেরের নিচের অংশ মার্বেল আবৃত, উপরের আধুনিক বিল্ডিং ফ্যাব্রিকে ঝালি দিয়ে অলংকৃত। পর্দা ঝুলানো দরজা, ভেতরে শুধু মহিলারা যেতে পারেন। আমরা বাহির থেকে জিয়ারত করি। এ সমাধির আগে একটি ঘেরে শায়িত হযরত মাওলানা ফখরুদ্দিন ফখর জাহান দেহলভী (রা.)। তিনি দ্বাদশ শতাব্দীতে চিশতীয়া সমপ্রদায়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বিখ্যাত সাধক এবং ভারতের উজ্জ্বল ইসলামী পণ্ডিতদের একজন। মার্বেল পাথরের সমাধিতে খোদাই করা শিলালিপিটি ১২২২ খ্রিস্টাব্দের। কুতুব সাহেবের মসজিদের দক্ষিণ–পশ্চিম কোণে অন্যতম প্রধান শিষ্য শায়খ নিজামুদ্দিন আবুলমাইয়াদের সমাধি। তিনি ৬৭২ হিজরিতে মারা যান। খিলজি স্থাপত্যশৈলীর ৮ স্তম্ভের বর্গাকার ছত্রীর সমাধিটির কাছেই রয়েছে তাঁর (আবুল মাইয়াদ) মা বিবি সারার সমাধি। তিনি ১২৪০–৪১ হিজরিতে মারা যান। হামিদুদ্দিন নাগোরীর সমাধির কাছেই ১৫–১৬ শতাব্দীর দুটি কবর, খাজা হাসান খৈয়াত এবং সাইকা বাবার। তাঁদের সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় না, সমাধিতে কোন ঐতিহ্যগত তথ্যও নেই। কোনওভাবে দরগার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে বিশ্বাস। দু’জনেরই গম্বুজসহ বড় কাঠামোর সমাধি।
কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকীর (রা.) সান্নিধ্যে সমাহিত হয়েছেন সম্রাটসহ মুঘল পরিবারের অনেক সদস্য। রাজকীয় সমাধিগুলি সবই মতি মসজিদ চত্বরে। দক্ষিণে সম্রাট প্রথম বাহাদুর শাহের (রাজস্ব ১৭০৭–১৭১২) সমাধি। তিনি পাঁচ বছর রাজত্ব করেন এবং ১৭১২ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। পরের কবরটি সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের (রা. ১৭৫৯–১৮০৬)। আফগান রোহিলা গোলাম কাদিরের নিষ্ঠুরতায় অন্ধত্ব বরণ করা এ সম্রাট ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে মারা যান। পশ্চিমে তাঁর ছেলে ও উত্তরাধিকারী সম্রাট দ্বিতীয় আকবরের (রা. ১৮০৬–১৮৩৭) কালো মার্বেল পাথরের সমাধি। তিনি প্রায় ৩৮ বছর রাজত্ব করেন এবং ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দে মারা যান। এরপরে দ্বিতীয় আকবরের স্ত্রী শাহ আবাদীর এবং তার চারপাশে বেশ কয়েকটি পরিচয়হীন কবর, যা রাজপরিবারের মহিলাদের বলে ধারণা। আজমেরী গেটের উত্তর–পশ্চিমে সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের স্ত্রী মুরাদ বখতের পার্সিয়ান স্থাপত্যশৈলীর সমাধি। শেষ মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরেরও ইচ্ছে ছিল এ দরগার পাশে সমাধিস্থ হওয়ার। দুর্ভাগ্যক্রমে, তাঁকে বার্মায় নির্বাসিত করা হয়েছিল। সেখানে তিনি মারা যান, রেঙ্গুনে (বর্তমান ইয়াঙ্গুন) সমাহিত করা হয়। সারদগাহ নামে পরিচিত তাঁর পরিকল্পিত কবরটি এখনও খালি রয়েছে। তার দেহাবশেষ এখানে ফিরিয়ে আনার কথা সময়ে সময়ে উঠে। ইয়াঙ্গুনে দুইবার সফরে গিয়ে অনেকটা অবহেলায় পড়ে থাকা বাহাদুর শাহ জাফরের সমাধিটিও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। পশ্চিম প্রবেশদ্বার থেকে উত্তরে হরিয়ানা রাজ্যের ঝাজ্জারের নবাবদের (ঊনবিংশ শতাব্দী) সমাধি ঘের রয়েছে। যার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রথম নবাব নিজাবত আলী খান, পরবর্তী নবাব ফয়েজ মুহাম্মদ খান এবং শেষ নবাব ফয়েজ আলী খানের সমাধি। প্রথম নবাব নিজাবত আলি খান দিল্লির গভর্নর জেনারেল লর্ড লেক জায়গিরে রাজত্ব পেয়েছিলেন আর শেষ নবাব ফয়েজ আলী খান ১৮৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অংশ নিয়ে ব্রিটিশের হাতে ফাঁসিতে জীবন দেন। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বীরত্ব ও সাহসের জন্য বিখ্যাত ঝাজ্জার সেনারা। ঝাজ্জার নবাবদের ঘেরের কাছেই আওরঙ্গজেবের দরবারের বিখ্যাত খোজা মুআতমাদ খানের (সপ্তদশ শতাব্দী) সমাধি। তার ঘেরে ইলাহি বক্সের পরিবারেরও কবর রয়েছে। এই কবর ঘেরের পূর্ব দিকে প্রাক–মুঘল আমলের মসজিদটি অষ্টাদশ শতাব্দীতে মাওলানা ফখরুদ্দিন নির্মাণ করেছিলেন।
মুঘল শাসক ফররুখসিয়ারের গড়া দ্বিতীয় প্রবেশদ্বারের দক্ষিণে বান্দার (উত্তর প্রদেশ) নবাবদের পাঁচটি সমাধি রয়েছে। তিনটি মার্বেলের-বান্দার প্রথম নবাব আলী বাহাদুর (১৭৫৮-১৮০২) এবং তার দুই ছেলে ও উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় শমসীর বাহাদুর ও জুলফিকার বাহাদুর। বাকি দুটি তাদের পরিবারের মহিলাদের। মজলিস খানার উত্তরে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধজয়ী আফগান রোহিলা নজিবুদ্দৌলার ছেলে জাবিতা খানের সমাধি, যিনি ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দে আমিরুল উমারা প্রধান হয়েছিলেন, ১৭৮৫ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। মুঘল স্থাপত্যশৈলীর মার্বেল কাঠামোর সমাধিটি কোরানের বাণী উদ্ধৃতি দিয়ে খোদাই করা। একই প্ল্যাটফর্মে আরেকটি কবর, সম্ভবত জাবিতার স্ত্রীর। সুলতান ইলতুৎমিশের ভাগ্নে আলাউদ্দিনের সমাধিও দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের প্রাসাদের দক্ষিণে রয়েছে। তার সম্পর্কে আর কিছু জানা যায়নি।
কুতুব সাহেবের দরগাহ সমাহিত হওয়ার জন্য ভক্তদের আকাংক্ষার প্রমাণ মেলে বিভিন্ন সমাধির শিলালিপিতে। যেমনটি আছে মোতোমাদ খানের সমাধির শিলালিপিতে, ‘মোতামাদ খান শাহ কুতুবউদ্দিনের পায়ের ধুলো বেছে নেন, যার সান্নিধ্যে তিনি মহান আল্লাহতায়লা ক্ষমার আশা রাখেন। তাঁর আশেপাশের সবাই আলোয় আলোকিত হবে এবং বিচারের দিন তাঁর কপালের উজ্জ্বলতায় চাঁদের মতো আলোকিত হবে’। (চলবে)
লেখক: সাংবাদিক, গবেষক