সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহারে অনেকেই অভ্যস্ত নয়। মেশিনের মাধ্যমে কোনো ডিজিটাল কারচুপি হয় কি না, পৃথিবীর অনেক দেশ ইভিএম বাতিল করে দিয়েছে, কেন করলো সেটা গবেষণা করা উচিত বলেও অনেকে মতামত দিয়েছেন।”
আজ মঙ্গলবার (২২ মার্চ) রাজধানীতে নির্বাচন ভবনের সভাকক্ষে বেলা সোয়া ১১টা থেকে তিন ঘণ্টাব্যাপী এক সংলাপে এ কথা বলেন তিনি।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা ইভিএম-এর ব্যবহার নিয়ে জোর আপত্তি তুলেছেন। একই সঙ্গে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাধার সম্মুখীন হলে পদত্যাগের পরামর্শও দিয়েছেন তারা।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে বৈঠকে তিন নির্বাচন কমিশনার, ইসি’র সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া আমন্ত্রিত ৩৯ জন বিশিষ্ট নাগরিকের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন ১৯ জন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিডিপি) ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, “ইভিএমের ব্যবহার অত্যন্ত বিতর্কিত বিষয়। এটা থেকে দূরে থাকা ভালো। ইভিএম ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও জটিল করতে দিতে পারে। ইভিএম ঝুঁকি নিয়ে ব্যবহার করা উচিত নয়।”
তিনি বলেন, “নির্বাচন ব্যবস্থাপনার ওপর আস্থা ফিরিয়ে আনাই চ্যালেঞ্জ। নির্বাচনকালীন আইন-বিধির যথাযথ প্রয়োগ করতে পারেন কি-না তা দেখা যাবে। অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন করবেন। সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। আর প্রতিবন্ধকতা এলে পদত্যাগের সাহস রাখবেন।”
সিপিডি’র ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “ইভিএম ব্যবহার করলেই প্রশ্নবিদ্ধ হবেন। তাই এটি ব্যবহার না করে একটি ভালো ও নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন দেবেন।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ফরাস উদ্দিন বলেন, “ইভিএম সব সময় বিতর্কিত। এই বিতর্কের সমাধান না করে ব্যবহার করা ঠিক নয়। জোরের সঙ্গে বলব- ইভিএম ব্যবহার না করার জন্য।”
তিনি জানান, ভোটের-আগে পরে ছয় মাস নির্বাচনকালীন কর্তৃত্ব কমিশনের কাছে থাকা উচিত। এক্ষেত্রে ভোটের আগে চার মাস, ভোটের পরে দুই মাস; এ ছয় মাস ইসি’র হাতে ক্ষমতা থাকতে পারে।
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, “বিনা টেন্ডারে কীভাবে ইভিএম এলো। ইভিএম নিয়ে একজনের এত উৎসাহ কেন, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করতে হবে। কোনোভাবে বড় পরিসরে ইভিএম ব্যবহার করা যাবে না। চাইলে ৫ থেকে ১০ কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করতে পারে। তবে এটা না হওয়াই ভালো।”
তিনি বলেন, “সার্চ কমিটির কারণে বর্তমান কমিশন কিছুটা আস্থা সঙ্কটে পড়েছে। সবার নাম প্রকাশ করেনি কমিটি। এছাড়া নূরুল হুদা কমিশনের সাবেক সচিব এবং আরেক সাবেক সচিবের শ্বশুর আওয়ামী লীগ নেতা হওয়ায় নতুন ইসি’র দুই সদস্য নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।”
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “নির্বাচনকালীন সরকারের চরিত্রের ধরন, কেমন নির্বাচন হবে- এ নিয়ে বিদ্যমান আইন-বিধিতে কী ধরনের পরিবর্তন আনা যায় সেই বিষয়ে কাজ করতে হবে। সমঝোতায় পৌঁছানোর জন্য আইনে কোনো পরিবর্তন করা যায় কি না তা চিহ্নিত করুন আপনারা। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আপনাদেরই নিতে হবে। সরকারের অনুগত না থেকে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করে যেতে হবে। প্রয়োজনে ইস্তফা দেবেন। সব অংশীজন, ভোটার, আমরা আপনাদের পক্ষে আছি।”
সংলাপের অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক রুবায়েত ফেরদৌস, সাবেক সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক বেগম শাহীন আনাম, নিজেরা করির কো-অর্ডিনেটর খুশী কবির, বাংলাদেশ ইনডিজিনিয়াস পিপলস ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং ও সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের (সিইউএস) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, ঢাবি আইন বিভাগের অধ্যাপক হাফিজুর রহমান কার্জন, গভর্নেন্স অ্যান্ড রাইট সেন্টারের প্রেসিডেন্ট জহুরুল আলম, ঢাবি গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক শামীম রেজা, সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মহিউদ্দীন আহমেদ।
সবার মতামত নিয়ে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, “আমাদের হারানোর কিছু নেই। যে বয়স হয়ে গেছে তাতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ারও সম্ভাবনা নেই। কাজেই আমাদের আসলে পাওয়ার কিছু নেই। এখান থেকে জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আমরা যদি ইতিবাচক কিছু করতে পারি, আপানারা যে সাজেশনগুলো দিয়েছেন, ওগুলো বিবেচনায় নিয়ে নির্বাচনকে যদি অবাধ ও সুষ্ঠু করা যায়, তাহলে সেটা আমাদের সবার অংশগ্রহণে একটা সফলতা হতে পারে।”
সিইসি বলেন, “১০০ শতাংশ সফলতা হয়তো হবে না, হয়ও না কখনো। কিন্তু কেউ বলেছেন সেটা যদি ৫০ শতাংশ ৬০ শতাংশও গ্রহণযোগ্য হয়, সেটাও বড় সফলতা।”
তিনি আরও বলেন, “বিগত নির্বাচনে বেশ কিছু কারণে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। কেউ বলছে ভোট দিচ্ছে না। তবে নারায়ণগঞ্জের ইলেকশন খুব সুন্দর হয়েছে। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনের (ইভিএম) মাধ্যমের এটা একটা বড় দিক। এছাড়া যদি কোনোরকম কারচুপি হয়ে থাকে তাহলে রিকাউন্টিং করা যাবে কি না, এটার কোনো ব্যবস্থা আছে কি না, তা আমাদেরও বুঝতে হবে। আমাদের টেকনিক্যাল কমিটির মিটিং করে একটা ধারণা নিতে হবে।”
এর আগে গত ১৩ মার্চ শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপ করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওইদিনও আমন্ত্রিতদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশই সাড়া দেননি। বর্তমান কমিশন গত ২৬ ফেব্রুয়ারি নিয়োগ পাওয়ার পর ২৭ ফেব্রুয়ারি শপথ গ্রহণ করে। ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে তারা দায়িত্ব বুঝে নিয়েই সংলাপের উদ্যোগ নেয়।
এরপর গণমাধ্যম, নারী নেত্রী ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে সংস্থাটি। কাজী হাবিবুল আউয়ালের বর্তমান কমিশনের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। এক্ষেত্রে ২০২৩ সালেই শুরু হয়ে যাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি।