স্বতন্ত্র যাত্রার কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান

এস ডি সুব্রত | শুক্রবার , ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:০৩ পূর্বাহ্ণ

সমকালীন বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। ষাটের দশকের অন্যতম উজ্জ্বল কথাসাহিত্যিক রিজিয়া রহমান। পেছনে রেখে গেছেন প্রায় পাঁচ দশকের সাহিত্যকীর্তি, যদিও সমকালীন সাহিত্যিক মহলে তাঁর নাম অনেকটা অনুচ্চারিতই ছিল। সভাসমাবেশসাহিত্যমঞ্চে কোথাও তাঁর উপস্থিতি ছিল না তেমন। কিন্তু বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সাহিত্যযাত্রায় রিজিয়া রহমানের অবদান অপরিসীম। রিজিয়া রহমানের জন্ম কলকাতায় ২৮ ডিসেম্বর ১৯৩৯, মৃত্যু: ১৬ আগস্ট ২০১৯ । শৈশবটাও কেটেছে ওখানে। মা ছিলেন শিক্ষিত ও গুণী। বাবা পেশায় চিকিৎসক। সাহিত্যসংস্কৃতিইতিহাস চর্চা হতো তাদের পরিবারে। লেখালেখি করার মতো চমৎকার পারিবারিক আবহে তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। আমাদের অধিকাংশ পরিবারে যেখানে কবিতা লেখার জন্য পিতামাতা অখুশী হন, সেখানে ক্লাস ফাইভে একটি কবিতা লিখে বাড়ির সকলকে তাক লাগিয়ে দেন রিজিয়া রহমান। পরিবারে তাঁর কদর বেড়ে যায়। বাড়িতে মেহমান আসলে কবিতা পড়ে শোনানোর ডাক পড়ত তার। দেশভাগের পর এই পরিবারটিকে চলে আসতে হয় ঢাকায়। রিজিয়া রহমান চোখের সামনে বদলে যেতে দেখেন সমাজ দেশ রাষ্ট্র, এমনকি নিজের আত্মপরিচয়টাও। বাবা সরকারি ডাক্তার ছিলেন। দেশভাগের পরে পূর্ব পাকিস্তানে চলে এলে পোস্টিং দেওয়া হয় ফরিদপুরে। ওখানেই রিজিয়া রহমানের প্রাথমিক শিক্ষা শেষ হয়। স্কুলে পড়ার সময় প্রথম কবিতা ছাপা হয় একটি পত্রিকার ছোটদের পাতায়। এভাবে কবিতা ও ছড়া দিয়ে লেখালেখির শুরু হলেও কলেজ জীবনে শুরু করেন গল্প লেখা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্স করার সময় একটি গল্প ছাপা হলো ম্যাগাজিনে। গল্পটি ছাপানোর পেছনে যে গল্প, তার মধ্য দিয়ে আমরা উপলব্ধি করতে পারি রিজিয়া রহমান লেখালেখি জীবনের শুরু থেকেই আপোস করেননি। গল্পটি প্রকাশের আগে অশ্লিলতার অভিযোগ তোলেন বিভাগীয় প্রধান। উনার আপত্তি বাধে ‘হুইস্কি’ শব্দটি নিয়ে। গল্পের চরিত্রটি অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়ে, ফলে সে পরিবারের কথা বলতে গিয়ে হুইস্কির প্রসঙ্গ এসেছে। শিক্ষক বলেন, ‘হুইস্কি’ শব্দটি ফেলে দিলে গল্পটি প্রকাশিত হবে। রিজিয়া রহমান বললেন, ‘থাক স্যার। গল্পটা ছাপার দরকার নেই।’ প্রথম গল্প ছাপা হওয়ার মোহ তিনি দমন করেছেন। পরে অবশ্য কোনোরকম কাটছাট ছাড়া সেটি প্রকাশিত হয়।

রিজিয়া রহমান আমৃত্যু লেখক হিসেবে কোনো বিশেষ সুবিধা আদায়ের জন্য কাটছাট করেননি।

ছোটগল্প, কবিতা, শিশুসাহিত্য, আত্মজীবনী, অনুবাদের পাশাপাশি তিনি ৩০টার বেশি উপন্যাস লিখছেন। রিজিয়া রহমানের প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় সত্তর দশকের শুরুতে। তিনি ষাট দশকের লেখক। তাঁর উপন্যাসে বিষয়বৈচিত্র্য চোখে পড়ার মতোন। প্রাচীন বাংলার ইতিহাস থেকে আধুনিক বাংলাদেশের জন্মকষ্ট, স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতা, বস্তিবাসী, বারবণিতা, চাশ্রমিক, সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর জীবনলড়াই, প্রবাসীজীবনের নানা সংকট থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট উপজীব্য হয়ে উঠেছে। তিনি লিখেছেন কঠিন শ্রম ও সাধনায় নিজের বিশ্বাসের জায়গা থেকে। রিজিয়া রহমানের প্রথম উপন্যাস ‘ঘর ভাঙা ঘর’। স্বাধীনতার পর নদী ভাঙনে শিকার মানুষেরা ঢাকায় চলে আসছে বেঁচে থাকার জন্য। গড়ে উঠছে বস্তি। তাদের নিয়ে এই উপন্যাস। পতুর্গিজ জলদস্যুদের কাহিনি নিয়ে লিখলেন ‘উত্তরপুরুষ’ উপন্যাসটি। আট হাজার বছর আগের সমাজ নিয়ে লিখলেন নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস ‘শুধু তোমাদের জন্য’। পাশাপাশি ‘পবিত্র নারীরা’ ও ‘তৃণভূমি বাইসন’ নামে আরও দুটি নৃতাত্ত্বিক উপন্যাস তিনি লেখেন। ‘কাছেই সাগর’, ‘বং থেকে বাংলা’, ‘উত্তরপুরুষ’, ‘একটি ফুলের জন্য’ উপন্যাসগুলো লিখেছেন মুক্তিযুদ্ধ ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট থেকে। ‘অলিখিত উপখ্য্যাান’, ‘আবেরওয়াঁ’ ও ‘আল বুরুজের বাঘ’ উপন্যাসগুলো ইতিহাস নির্ভর । চাশ্রমিকদের জীবনবাস্তবতা নিয়ে লিখেছেন ‘সূর্য সবুজ রক্ত’ উপন্যাসটি। নব্বইয়ের স্বৈরচারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে লেখেন ‘হারুণ ফেরেনি’ উপন্যাসটি। ‘বাঘবন্দি’ উপন্যাসটি মনস্ত্বাত্ত্বিক উপন্যাস। নতুন আঙ্গিকে লেখা। মনের ভয় বাঘের প্রতীক হিসেবে এসেছে। গ্রামে বাঘ ঢুকেছে। সবাই ভয় পাচ্ছে। একেকরকম ভয় থেকে বাঘটাকে একেকজন ভিন্ন ভিন্ন করে বর্ণনা করে। যেমন, মৌলবি ওয়াজে বলছেন, মেয়েরা সবাই পর্দা থেকে বেরিয়ে এসেছে, কাজে যাচ্ছে, এজন্য বাঘটা এসেছে। প্রেমের উপন্যাস লিখেছেন বেশ কয়েকটি, যেমন-‘সবুজ পাহাড়’, ‘প্রেম আমার প্রেম’, ‘তবু গোলাপ তুমি’, ‘বান্ধবী প্রিয়দর্শিনী’, ‘ঝড়ের মুখোমুখি’ ইত্যাদি। এভাবেই রিজিয়া রহমান কোনো একটি বিষয় বা প্রেক্ষাপটে নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি। তিনি প্রতিনিয়ত নতুন নতুন প্লটের সন্ধান করেছেন। যখন যেবিষয় নিয়ে লিখেছেন সে বিষয়ে ফিল্ডওয়ার্ক করেছেন। সময় নিয়ে খেটে তিনি লিখেছেন সেই উপন্যাস, যা তিনি লেখা উচিত বলে মনে করেছেন। ‘নারী লেখকের’ দুর্বলতা তাঁর উপন্যাসে নেই, বরং উপন্যাসের বিষয় নির্বাচন, বর্ণনাকৌশলের দিক থেকে তিনি স্বতন্ত্র ছিলেন। তথাকথিত জনপ্রিয় ধারার দিকে তিনি যাননি। ষাটের দশকের শুরুতে দৈনিক ইত্তেফাকের সাহিত্য পাতায় ‘অনন্য পৃথিবী’ নামে একটি গল্প ছাপা হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি সাহিত্যজগতে প্রবেশ করেন। ঊনিশশো সাতষট্টিআটষট্টি সালের দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে মাস্টার্স পড়ার সময় তিনি প্রথম উপন্যাস ঘর ভাঙা ঘর (১৯৭৪) লেখা শুরু করেন এবং সাপ্তাহিক ললনায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হলে তা পাঠকমহলে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। স্বামীর চাকরিসূত্রে ঊনিশশো ঊনসত্তরের দিকে তিনি তখন চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। এসময় সাপ্তাহিক ললনার অনুরোধে মাত্র পনেরো দিনের মধ্যে চট্টগ্রামে পর্তুগিজদের উত্তরপুরুষ ফিরিঙ্গি বাজারের আধুনিক ফিরিঙ্গিদের জীবনযাপন নিয়ে ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে লেখেন দ্বিতীয় উপন্যাস উত্তরপুরুষ (১৯৭৭)। স্বাধীনতাপরবর্তীকালে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ঈদসংখ্যায় (১৯৭৭) প্রকাশিত হয় তাঁর তৃতীয় উপন্যাস রক্তের অক্ষর। রিজিয়া রহমান সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেনবাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৭৮), যশোর সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার (১৯৮৪), হুমায়ুন কাদির স্মৃতি সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), আসফউদদৌলা রেজা স্মৃতি পুরস্কার (১৯৮৪), বাংলাদেশ লেখক সংঘ সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৫),কমর মুশতারি সাহিত্য পদক (১৯৯০),অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৫),নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক, একুশে পদক (২০১৯)

রিজিয়া রহমান ছিলেন একজন ব্যতিক্রমী কথাসাহিত্যিক। সাহিত্য আসর, বক্তৃতামঞ্চ, টেলিভিশন, বিদেশযাত্রায় তাঁকে তেমনভাবে দেখা যায়নি। আমন্ত্রণ পেলে সবিনয়ে ফিরিয়ে দিতেন। বিশ্বাস করতেন লেখকের কাজ লেখা। আপনমনে লিখে গেছেন একের পর এক অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ভিন্নধর্মী লেখা। তাঁর প্রতিটি লেখাই আলাদা। নির্মাণভঙ্গি এবং বিষয়বৈচিত্র্য স্বতন্ত্র। তিনি ছিলেন আত্মমর্যাদাশীল। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে রিজিয়া রহমানের মত আত্মপ্রত্যয়ী আর আত্মমর্যাদাশীল লেখকের খুব অভাব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসোনাইমুড়ী থানা কল্যাণ সমিতির কৃতী শিক্ষার্থীদের সংবর্ধনা
পরবর্তী নিবন্ধঅলস করতালিমাখা সুন্দরের জয়গান