হযরত ইউসূফ (আ.)’র পরিচিতি:
হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম আল্লাহর মনোনীত নবীদের অন্যতম। তাঁর পিতার নাম হযরত ইয়াকুব (আ.), মাতার নাম রহীল বিনতে লাবান। তার দাদার নাম হযরত ইসহাক (আ.) বংশ পরিচয় ইউসূফ ইবন ইয়াকুব ইবন ইসহাক ইবন ইবরাহীম আলাইহিমুস সলাম। হযরত ইয়াকুব (আ.) এর বারোজন পুত্র সন্তানদের মধ্যে অন্যতম হযরত ইউসূফ (আ.)। হযরত আদম (আ.) হতে ইউসূফ (আ.) এর জন্ম পর্যন্ত ২১৭৯ বছরের ব্যবধান ছিল। (ইবন কাছীর, ক্বাসাসুল আম্বিয়া, পৃ: ১১৩)
পবিত্র কুরআনে তাঁর নামে (সূরা ইউসুফ) একটি সূরার নামকরণ হয়েছে, পবিত্র কুরআনে মোট ৩৪ জায়গায় তাঁর মুবারক নাম উল্লেখ রয়েছে। নবীদের মধ্যে একমাত্র নবী যার পুরো জীবন ও কর্মের বৃত্তান্ত একটিমাত্র সূরায় ধারাবাহিকভাবে বর্ণিত হয়েছে, এ ছাড়া অন্যত্র সূরা আনআম ৮৪ এবং সূরা মুমিন ৩৪ আয়াতে তাঁর নাম উল্লেখ রয়েছে। তাঁর পবিত্র জীবনের ঘটনাকে আল কুরআনে “আহসানুল কাসাস” উত্তম কাহিনী নামে অভিহিত করা হয়েছে। তাঁর ভাইদের চক্রান্তে শিশুনবী হযরত ইউসূফ (আ.) একটি কূপে পতিত হয়েছিলেন, একদল বণিক কর্তৃক তাঁকে কুয়া থেকে উদ্ধার করা হয়। মিশরের সম্রাট আযীযের পত্নী জুলায়খার চক্রান্তে তাঁেক কারাগারে বন্দী করা হয়। পরে মিশরের সম্রাট আযীযের একটি স্বপ্নের যথাযথ সঠিক ব্যাখ্যা বলে দেওয়ার কারণে তাঁকে কারাগারের বন্দী দশা থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মিশর সম্রাটের অধীনে তিনি খাদ্য মন্ত্রীর দায়িত্বপ্রাপ্ত হন, পরে তিনি মিশরের বাদশাহ হন।
সূরা ইউসূফ অবতরণের প্রেক্ষাপট:
সূরা ইউসূফ মক্কী, এ সূরার বৈশিষ্ট্য নবুওয়াতের দায়িত্ব পালনের দিক নির্দেশনা, দ্বীনি দাওয়াতের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি, বিরোধীতার ধরন বর্ণনা ও করণীয় কর্তব্য সম্পর্কে হেদায়ত, দ্বীনের পথে ধৈর্যধারণ ও জবাব দান, ব্যক্তি গঠনের হিদায়াত, সমাজ গঠনের ইঙ্গিত, অতীতের ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ ইত্যাদি। এ সূরাতে বারোটি রুকু, একশ এগারটি আয়াত, এক হাজার ছয়শত পদ এবং সাত হাজার একশ ছেষট্টি বর্ণ রয়েছে।
সূরা ইউসূফ এর শানে নুযুল:
সূরা ইউসূফ নাযিলের প্রেক্ষাপট অনুসন্ধানে জানা যায় যে, ইহুদী সম্প্রদায়ের আলিমগণ আরবের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি বর্গের উদ্দেশ্যে বলেছিলো, মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করুন! হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর সন্তানগন সিরিয়া থেকে মিশরে কিভাবে পৌঁছলো এবং তারা সেখানে গিয়ে বসবাস করার কারণ কি ছিলো? হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম’র ঘটনা কি? এর জবাবে আল্লাহ তা’আলা এ দীর্ঘ সূরা নাযিল করেন। (কানযুল ঈমান কৃত ইমাম আহমদ রেযা (রহ.) তাফসীরে খাযাইনুল ইরফান কৃত সদরুল আফাযিল মাওলানা সৈয়দ নঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (রহ.), পৃ: ৪২৮)
পবিত্র কুরআনের আলোকে হযরত ইউসূফ (আ.) এর মর্যাদা:
আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনে এরশাদ করেছেন, স্মরণ করুন! যখন ইউসূফ তার পিতাকে বললো হে আমার পিতা! আমি স্বপ্ন দেখেছি যে, এগারটি নক্ষত্র এবং সূর্য ও চন্দ্র আমাকে সিজদা করছে (একথা শুনে তাঁর পিতা) বললো হে আমার পুত্র! আপন স্বপ্ন তোমার ভাইদের নিকট বর্ণনা করো না। তাহলে তারা তোমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করবে নিশ্চয় শয়তান মানুষের প্রকশ্য শত্রু। (সূরা: ইউসূফ, আয়াত: ৪,৫)
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীরে খাযাইনুল ইরফানে সদরুল আফাযীল আল্লামা সৈয়দ নঈম উদ্দিন মুরাদাবাদী (রহ.) বর্ণনা করেন যে, হযরত ইউসূফ (আ.) স্বপ্নে দেখেন, আসমান থেকে এগারটা নক্ষত্র অবতরণ করেছে সেগুলোর সাথে সূর্য এবং চন্দ্রও রয়েছে, সে সবই তাঁকে সিজদা করছে, তিনি শুক্রবারে এ স্বপ্ন দেখেছিলেন সে রাতটাও ছিলো শবে কদর মহিমান্বিত রজনী। নক্ষত্র গুলোর ব্যাখ্যা হচ্ছে তাঁর এগারজন ভ্রাতা, সূর্য হচ্ছে তাঁর পিতা, আর চন্দ্র হচ্ছে তাঁর মাতা অথবা খালা। তাঁর মহীয়সী মাতার নাম “রাহীল” রাহীল প্রথমে বন্ধ্যা ছিলেন তাঁর সন্তান হয় বৃদ্ধ বয়সেই, তিনি বিনইয়ামীন ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় ওফাত হয়েছেন, তখন হযরত ইউসূফ (আ.)’র বয়স ছিলো দু’বছর। সূদ্দীর অভিমত হলো, চন্দ্র দ্বারা তাঁর খালা বুঝানো হয়েছে, যেহেতু ইউসূফ (আ.) এর দু বছরে তাঁর মাতা রাহীল এর ইন্তিকাল হয়েছিলো। সিজাদার অর্থ জমিনে কপাল স্থাপন করা। সিজদা দু’ প্রকার তাব্বুদী, একমাত্র আল্লাহর ইবাদতের উদ্দেশ্য আল্লাহকে সিজদা করা। ২. সিজদা–এ তাহিয়্যাহ সম্মানসূচক সিজদা। সেই যুগে সম্মান সূচক সিজদা জায়েজ ছিল, হযরত ইউসূফ (আ.) এর বয়স ছিলো তখন বার বছর। এক বর্ণনায় সাত বছর ও সতের বছর। হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শরীয়তে আল্লাহ ছাড়া কাউকে সিজদা করা যদিও তাজিমের নিয়্যাতের হয় তা সম্পূর্ণরূপে হারাম ও কবীরা গুনাহ। ইউসূফ (আ.)’র প্রতি তাঁর পিতা ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর গভীর স্নেহ ছিলো, এ কারণে তাঁর প্রতি তাঁর ভাইয়েরা ঈর্ষা করতো, হযরত ইয়াকুব (আ.) সে সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। ইয়াকুব (আ.) জানতেন যে, আল্লাহ তা’আলা হযরত ইউসূফ (আ.)কে নবুওয়তের জন্য মনোনীত করবেন এবং উভয় জাহানের অনুগ্রহ ও মর্যাদা দান করবেন। বর্ণিত আয়াতে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, ইউসূফ (আ.) এর ভাইয়েরা যদি তাঁকে কষ্ট দেয়ার বা তাঁর ক্ষতি সাধনের কোন পরিকল্পনা চক্রান্ত বা পদক্ষেপ গ্রহণ করে তা শয়তানের প্ররোচনাতেই হবে। (তাফসিরে খাযিন)
হযরত ইউসুফ (আ.) এর দ্বীনি দাওয়াত:
আল্লাহর নবীগণ সর্বদা আল্লাহর একত্ববাদের দাওয়াত প্রচারে নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন হযরত ইউসূফ (আ.) তিনিও তাঁর জাতিকে শির্ক সম্পর্কে সতর্ক করেছেন। তিনি তাঁর পূর্বসূরী আম্বিয়া আলাইহিমুস সালাম এর অনুসরণ করেছেন আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, “এবং আমি তাঁকে ইসহাক ও ইয়াকুবকে দান করেছি। তাঁদের সবাইকে আমি সৎপথ দেখিয়েছি এবং তাঁদের পূর্বে নূহকে সৎপথ প্রদর্শন করেছি। আর তাঁর সন্তানদের মধ্যে থেকে দাউদ, সুলায়মান আইয়ুব ইউসূফ মুসা এবং হারুনকেও এবং আমি অনুরূপভাবে প্রতিদান দিয়ে থাকি সৎকর্মপরায়ণদেরকে। (সূরা: আনআম, আয়াত: ৮৪)
ব্যাখ্যায়: বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় প্রখ্যাত তাফসীরকার হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) তাফসীরে নূরুল ইরফানে বর্ণনা করেন, হযরত ইবরাহীম (আ.) হলেন “আবুল আম্বিয়া” নবীগণের পিতা, তাঁর পরবর্তী সকল নবীই তাঁর বংশধরদের মধ্যেই হয়েছে। আয়াতে পথ দেখানো মানে সম্মানিত নবীগণকে তাঁদের জন্মের পূর্বেই মহান রব স্বীয় জাত ও সিফাত (সত্বা ও গুণাবলী) সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্যকারী হিদায়াত দান করে থাকেন। হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম জন্ম গ্রহণ করতেই বলেছেন “আমি আল্লাহর বান্দা, তাঁর রাসূল ও বরকতওয়ালা”। আয়াত থেকে প্রতীয়মান হয় সুসন্তানও সৎকর্ম পরায়ণদের সৎকর্মের ফসল। পবিত্র কুরআনে আরো এরশাদ হয়েছে,এরা হচ্ছে এমন সব লোক যাদেরকে আল্লাহ হিদায়ত করেছেন সুতরাং আপনি তাদেরই পথে চলুন আপনি বলুন আমি কুরআনের জন্য তোমাদের নিকট কোন পারিশ্রমিক চাইনা। তা–তো নয় কিন্তু উপদেশ সমগ্র বিশ্বের জন্য। (সূরা: আনআম, আয়াত: ৯০)
আল্লাহর নবী হযরত ইউসূফ আলাইহিস সালাম ১১০ বছর অথবা ১২০ অথবা ১২৬ বছর বয়সে মাওলায়ে হাকিকীর সান্নিধ্যে ওফাত প্রাপ্ত হন। তিনি মিসরে ইন্তিকাল করেন, প্রসিদ্ধ বর্ণনামতে তাঁকে মিসর থেকে এনে ফিলিস্তিনের হেবরনে তাঁর পূর্ব পুরুষদের কবরস্থানে দাফন করা হয়।(ইবনে কাছীর, কন্ড:১, পৃ: ২৫৩–২৫৪, আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
ইয়া আল্লাহ! আমাদেরকে নবী–রাসূল আলাইহিমুস সালাম’র আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রি), বন্দর, চট্টগ্রাম, খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।












