গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরী ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায়ও শীর্ষস্থান দখল করেছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা আইকিউএয়ারের তথ্যানুসারে, বুধবার সকাল ৯টায় রাজধানীর বাতাসের স্কোর ২৩৯। অর্থাৎ, ঢাকার বায়ুমান ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ ক্যাটাগরিতে অবস্থান করছে। তালিকায় পরের চারটি শহর যথাক্রমে কায়রো, তেহরান, দিল্লি ও সারায়েভো। শহরগুলোর স্কোর যথাক্রমে ১৯৭, ১৮৮, ১৮৭ ও ১৭২। চারটি শহরের বাতাসই ‘অস্বাস্থ্যকর’।
বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, বায়ুমান সূচক ৫০–এর নিচে থাকলে বিশুদ্ধ বাতাস ধরা হয়। ৫১–১০০ হলে তা সহনীয়। ১০১–১৫০–এর মধ্যে হলে সতর্কতামূলক বা সংবেদনশীল মানুষের (শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তি) জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১–২০০ হলে সবার জন্য অস্বাস্থ্যকর এবং সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে বাতাসকে খুব অস্বাস্থ্যকর বলা হয়। আর সূচক ৩০০ ছাড়ালে সেই বাতাস দুর্যোগপূর্ণ।
বাংলাদেশের সামগ্রিক একিউআই পাঁচটি দূষণকারী মানদণ্ডের ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করা হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে কণা পদার্থ (পিএম১০ এবং পিএম২.৫), কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাই–অক্সাইড, সালফার ডাই–অক্সাইড ও ওজোন। ঢাকা দীর্ঘদিন ধরেই বায়ুদূষণ সমস্যায় জর্জরিত। ঢাকার বাতাসের গুণমান সাধারণত শীতকালে অস্বাস্থ্যকর হয়ে যায় এবং বর্ষাকালে উন্নত হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার ভয়ানক ধুলো দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ কর্মপরিকল্পনা জরুরি। কেননা প্রতি বছর শীতকালে, বিশেষ করে নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়ুদূষণের পরিমাণ আরো বেড়ে যায়। যা নগরবাসীর মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। শীতের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শহরের বাতাসের গুণমানের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। নির্মাণাধীন স্থাপনা, ভাঙাচোরা রাস্তা, ইটভাটা এবং অন্যান্য উৎস থেকে দূষিত কণা প্রচুর পরিমাণে বাতাসে মিশে যাওয়ার কারণে এমন হচ্ছে। ধুলো দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য শহরের রাস্তাগুলোয় নিয়মিত পানি ছিটিয়ে দেয়া এবং শহরে অযোগ্য মোটরযানের চলাচল বন্ধ করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে, সব নির্মাণাধীন সাইট আচ্ছাদিত করে রাখার তাগিদও দিয়েছেন তাঁরা।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, বায়ুদূষণের কারণে প্রথমেই প্রভাব পড়ে শ্বাসযন্ত্রের উপরে। দূষিত বায়ুর কণা এতোটাই ক্ষুদ্র যে এটি সহজেই মানুষের চোখ নাক মুখ দিয়ে ঢুকে রক্তের সাথে মিশে যায় এবং ফুসফুস, হার্ট, কিডনি, লিভার ইত্যাদি আক্রান্ত করে থাকে। বায়ুদূষণে দেশের এমন দুঃসহ পরিস্থিতি হওয়া সত্ত্বেও তেমন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। বায়ুদূষণ বর্তমানে একটি আতঙ্কে পরিণত হয়েছে। এই বিপর্যয় থেকে বাঁচতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যথাযথ পদক্ষেপের প্রয়োজন। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ রোধে প্রতিটি নাগরিককে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। সেই হিসেবে বিশেষজ্ঞরা কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে, পরিকল্পিতভাবে কারখানাগুলোর ধোঁয়া কমিয়ে আনা; কারখানাগুলো শহরের বাইরে নিয়ে যাওয়া; ট্রাফিক জ্যামের সমাধান করা; উন্নত জ্বালানি ব্যবহার করা; এয়ার কন্ডিশনার কম ব্যবহার করা; প্রচুর বনায়ন করা যেতে পারে, কারণ গাছ বায়ুদূষণ প্রতিরোধে জোরালো ভূমিকা রাখে; বাড়িঘর ও আবাসিক এলাকায় পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা, যেখানে উদ্যান ও পুকুর থাকবে; শুষ্ক মৌসুমে দূষিত শহরে দুই–তিন ঘণ্টা পর পর পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করা; নির্মাণ কাজের সময় নির্মাণ স্থান ঢেকে রাখা, নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের সময় ঢেকে নেওয়া; রাস্তায় ধুলা সংগ্রহের জন্য সাকশন ট্রাক ব্যবহার করা; অবৈধ ইটুভাটা বন্ধ করে উন্নত প্রযুক্তির সেন্ড ব্লকের প্রচলন বাড়ানো; ব্যক্তিগত গাড়ি ও ফিটনেসবিহীন গাড়ি নিয়ন্ত্রণ করা ইত্যাদি। বাস্তবিক অর্থে আমাদের বেঁচে থাকতে হলে বায়ুদূষণ কমাতে হবে। এজন্য আমাদের প্রত্যেকের সচেতন হওয়া দরকার। দূষণরোধ করার জন্যে সকলকেই এগিয়ে আসতে হবে।
তাঁরা বলেন, বায়ুদূষণ আজ শুধু পরিবেশগত সংকট নয়; এটি একটি জনস্বাস্থ্য, অর্থনীতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা। দ্রুত শিল্পায়ন ও নগরায়ণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশ–ব্যবস্থাপনা না হলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হতে পারে। আর এই কাজে সরকার ও উদ্বুদ্ধকৃত জনগণের পরিকল্পিত সম্পৃক্ততাই সাফল্য আনতে পারে। বায়ুদূষণ সংক্রান্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড এবং আমাদের জাতীয় মানদণ্ড কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।







