এক আদর্শ মমতাময়ী নারীকে স্মরণ

শিউলী নাথ | শনিবার , ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৯:০৬ পূর্বাহ্ণ

মানুষের চেহারা দেখে যদি ভেতরের অভিব্যক্তি বুঝতে না পারো তবে জীবন থেকে এখনো তোমার অনেক কিছু শেখা বাকি রয়েছে’। শেষবার যখন তাঁর সাথে আমার দেখা হয় তখন এই কথাগুলো তিনি বলেছিলেন। শ্রদ্ধেয়া নুরুন নাহার বেগম আমার ‘বড় আপা’। লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুর উপজেলার ‘রায়পুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ এর সদ্য প্রয়াত সুযোগ্য প্রাক্তন প্রধান শিক্ষিকা। ৭ই ডিসেম্বর ২০২৫ ইং তারিখে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পাড়ি দিয়েছেন অন্যলোকে। সবার প্রিয় বড় আপা। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাকে কখনো আপা ডাকতে পারেনি। মায়ের বড় আপা ডাকার সূত্রে তিনি যে আমার মাসী। প্রাইমারি বা হাইস্কুলে কাউকে আপা ডাকতে না পারার কষ্ট যতটা ছিল তার চেয়ে বেশি আনন্দ ছিল সবাইকে মাসি ডাকতে পারার সুবিধায়। সেই সময়ে মেয়েদের জন্য রায়পুর উপজেলার একমাত্র সরকারি বালিকা প্রাথমিক ও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় বলতে এ দুটি বিদ্যালয় ছিল। বহুদূর থেকে মেয়েরা অনেক কষ্ট করে পড়তে আসতো এ বিদ্যাপীঠে। প্রাইমারি স্কুলে পড়াকালীন দূর থেকে তাঁকে দেখতাম। কী ভাবগাম্ভীর্য চলাফেরা! কথাবার্তা, আচারআচরণে অমায়িক। দৃঢ়চেতা, আদর্শবান এক নারী।

রায়পুর উপজেলার একমাত্র বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সুনাম রক্ষায় কঠোর পরিশ্রমে নেমে পড়েছিলেন তিনি। তখনকার বি. এড, এম. এড। নির্ভীক চিত্তের এই মানবী একাই স্কুলের পাশে একটা রুম নিয়ে থেকে গেছেন। যদিও পরবর্তীতে আরেকজন দিদিমণি পাশে ছিলেন। মাসি আমার মাকে খুবই স্নেহ করতেন। আমার ছোট ভাই সবে ৪৫ বছরের। ও মায়ের সাথে স্কুলে চলে আসতো। বড় মাসি প্রতিদিন ওকে ডেকে নিতেন। বলতেন মায়া, তোমার ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিও। নিজের ঘরে বসিয়ে গ্লাসভর্তি দুধ বিস্কুট এসব খাওয়াতেন। আসলে মাতৃস্নেহ ওনাকে খুবই টানছিল। অবশেষে বড় মাসি বিয়ে করেন শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক মোহাম্মদ হাসেম সাহেবকে। যিনি নোয়াখালীর আঞ্চলিক গানের জনক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। মাসির সূত্র ধরেই স্যার আমাদের বাসায় গানের আড্ডা বসাতেন। আমার বাবা ও অধ্যাপক রাধেশ্যাম কুরীসহ। দুসন্তানের জননী শ্রদ্ধেয়া নুরুন্নাহার বেগম শুধু শিক্ষাবিদ নন। তিনি ছিলেন সংগঠক ও সংস্কৃতিসেবক। যখন রায়পুর উপজেলা প্রশাসন রায়পুর সংগীত বিদ্যালয়কে স্থান দিলেন না, তখন মাসী বাবাকে বলেছেন, ‘ডাক্তার, চিন্তা করবেন না। আপনার সঙ্গীত বিদ্যালয় আমার স্কুলেই হবে’। এত উদার মনের মানুষ আজকাল সমাজে বিরল। পরবর্তীতে সংগীতের ব্যাপ্তি দেখে উপজেলা প্রশাসন সংগীত বিদ্যালয় অন্তর্ভুক্ত করে নেন। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম সভাপতি এবং পরবর্তীতে আজীবন উপদেষ্টা পদে মাসী আসীন ছিলেন।

১৯৮৬৮৭ সালে তাঁর উৎসাহে রায়পুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রথম সরস্বতী পূজা উদযাপন করে স্কুলের মাঠে। একই সাথে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। খেলাঘরসহ বিভিন্ন সংগঠনের কার্যক্রমও চলতো স্কুল মাঠে।

আজকের প্রজন্ম বুঝতেই পারবে না তিনি কতটা পরিশ্রম ও কষ্ট করেছেন এই পর্যায়ে আসার জন্য। আজ অনেক বিদ্যালয়, কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সুযোগসুবিধা তৈরি হয়েছে। আমাদের সময় যারা ছিলেন শিক্ষক হিসেবে এবং আমরা যারা ছিলাম তাঁর ছাত্রী হিসেবে তারা সত্যিই ভাগ্যবতী। বড় আপার কথা লিখতে গেলে শেষ হবে না। উনার স্মৃতি সহজে ভুলার নয়। জীবন গঠনের প্রাক্কালে তাঁকে পয়েছি বলেই আমরা কিছুটা হলেও জীবনকে গড়তে শিখেছি। যতদিন ‘রায়পুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ থাকবে ততদিন বেঁচে থাকবেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়া প্রধান শিক্ষিকা নুরুন নাহার বেগম। রায়পুরের ইতিহাসে, তাঁর ছাত্রীদের, সহকর্মীদের ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাঝে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশ্রেণিকক্ষ সংকটে সরকারি মহিলা কলেজে ফাহমিদা জামান
পরবর্তী নিবন্ধমূল্যবোধের অবক্ষয়ে আমাদের দায় ও করণীয়