আধুনিক বাংলা গানের উদ্ভব, বিকাশ ও চর্চার ইতিহাস বেশি দীর্ঘ নয়। একদিকে বিশ্ব ইতিহাসে সমাজের পরিবর্তন ও বিবর্তনে আদিম সাম্যবাদ থেকে দাসপ্রথা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, কোথাও কোথাও সাম্যবাদী সমাজ থেকে আবার সমগ্রবিশ্ব বিশেষত ইউরোপের সকল দেশে প্রবল প্রতাপরূপে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ধারায় সমাজ কাঠামোর আগমন ও আধুনিকায়নের পথে গোটা বিশ্ব,
অন্যদিকে ব্যক্তিবাদ, নগরায়ণ, প্রযুক্তির উন্নয়ন, যুদ্ধ, সংঘাত, ধর্মীয় ও নৈতিক রাজনীতিতে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব, আবার কৃষি ও আগুন আবিষ্কারের মত মানবইতিহাসে বিশাল অর্জনের সংগে দাসবিপ্লব, শিল্পবিপ্লব, ফরাসী বিপ্লব, প্রোটেসটেন্ট রিফরমেশন, ধর্মীয় বিপ্লব, রেঁনেসা এন্ড রিফরমেশন, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ইত্যাদি পেরিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্র সমূহের মানুষের মধ্যে জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী, রুচিসম্মত ভাব ও ভাষার দিকে যাত্রা শুরু হয় অর্থাৎ আধুনিক যুগের শুরুর সাথে সাথে সংগীতের জগতেও সুর, তাল সম্পর্কে নতুন নতুন ধারণার উদ্ভব ও উৎপত্তি হতে থাকে।
সমগ্রবিশ্বব্যাপী নানা পরিবর্তন আবর্তের অবস্থা ও সামাজিক সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পরিবর্তনের ধারা ও ইউরোপীয় সমাজে সংগীত সম্পর্কে নতুন দৃষ্টি ভংগী ও রুচির প্রভাবে ১৯৩০ সালের দিক থেকেই আধুনিক বাংলা গানের সূচনা। সেই থেকে শুরু হয়েছে বাংলায় মানবিক সংগীতের অগ্রযাত্রা।
মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা, হতাশা, উৎসাহ, উদ্দীপনা, বেদনা, যন্ত্রণা, মিলন, বিচ্ছেদ, সংগ্রাম, বিক্ষোভ নিয়ে রচিত হতে শুরু করে হাজার গান। সেই থেকে প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাংলা গানের প্রবাহটি দাঁড়িয়েছে মানবকেন্দ্রিক। অসংখ্য সংগীতকার তাদের রচনায় সৃজনশীলতা ও সৃষ্টির মাধ্যমে আধুনিক বাংলা গানের ধারা পুষ্ট করেছে।
বাংলা গানের ইতিহাসে আধুনিক যুগের সূচনা করেছিলেন রামনিধি গুপ্ত ওরফে নিধুবাবু।
নিধুবাবুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলা গানের মূল বিষয় ছিল দেবতার মহিমা কীর্তন। মানুষের কথা বলা হয়েছে যেখানে সেখানেও সে কথাকে দেবতা বা দেবতুল্য চরিত্রের মাহাত্ম্যের সংগে যুক্ত করা হয়েছে।
নিধুবাবু এসে বাংলা গানকে মানুষের গান করে তুললেন। তার গানকে বলা হয়েছে মানুষের হৃদয় সংগীত। মানুষের হৃদয়ের নানা অবস্থাই তাঁর গানের বিষয়। বাংলা গানে প্রকৃতপক্ষে মানুষের প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে শুরু হয় এর আধুনিক যুগ। নিধুবাবুর টপ্পা ছিল সেই আধুনিক যুগ সংগীত ।
রাম নিধি গুপ্ত দুটি মহৎ কাজ করেছিলেন বাংলা গানের সেই ঐতিহাসিক যুগ সূচনায়–
এক. একান্তভাবে মানুষের হৃদয়কে নিয়ে গান রচনা।
দুই. শৌরীমিয়া প্রবর্তিত হিন্দুস্তানী সুরভংগীর পরিবর্তে গানের পদের বক্তব্য প্রকাশমূলক স্বকীয় সুররীতির প্রবর্তন।
আমরা আগেই উল্লেখ করেছি আঠার শতকের শেষভাগে নিধু গুপ্তের টপ্পা গানের মাধ্যমে নরনারীর প্রেম বিরহের কাহিনিকে মূল বিষয় ভিত্তি করে ১৯৩০ সালের দিক থেকেই আধুনিক বাংলা গানের সূচনা।
যে গান প্রগতিশীল চিন্তাপ্রসূত যুগদাবী অনুযায়ী রচিত, যার পরিধি ব্যাপক। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে এ গানের কথা এবং ভাব ইত্যাদি বিষয়গুলির জন্ম হয়।
বাংলার প্রাচীনতম সংগীত সংস্কৃত মন্ত্র দ্বারা প্রভাবিত ছিল। তা ত্রয়োদশ শতাব্দীর জ্য়দেব রচিত গীতগোবিন্দের মত বৈষ্ণব কাব্যের প্রভাবে বিরচিত হয়েছিল। বৈষ্ণব পদাবলিতে আমরা দেখতে পাই সেখানে মানুষের হৃদয়ের কথা বলা হয়েছে অনেক। রাধা–কৃষ্ণ কাহিনি মানুষের কাহিনির অনুরূপ। তাদের আনন্দ বেদনা মানুষের মনের অবস্থারই সমতুল্য।
মংগলগানে মানুষের দুঃসাহসী সংগ্রামের কথা আছে। কিন্তু মানুষ সেখানে জয়ী হতে পারে নি। দেবতার মহিমা প্রকাশই হয়ে উঠেছে সেখানকার প্রধান ব্যাপার। এগুলো যথার্থ মানব সংগীত নয়। সে ক্ষেত্রে নিধুবাবু এসে বাংলা গানকে মানুষের গান করে তুললেন।
তিরিশ পরবর্তী বাংলা আধুনিক গানের উপর তিনটি জিনিস গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে চলে–
এক. সবাক চলচ্চিত্রের যাত্রা।
দুই. গ্রামোফোন কোম্পানীর রেকর্ড উৎপাদন।
তিন. রেডিওর সংগীত প্রচার।
যার মধ্যে চলচ্চিত্র ও গ্রামোফোন কোম্পানির প্রভাব ছিল বেশি।
এতদিন বাংলায় গান ছিল, গানের ব্যবসা ছিল না। সংগীতকার গণসংগীত রচনা করতেন মনের কথাটি বলার জন্য। দেখা গেল মনের কথা বলার সংগে ক্রয় বিক্রয় কথাটি এসে যুক্ত হল। মানুষকে খুশী করার গান, বিক্রি করার জন্য গান, দারুণ দাপটে প্রতিষ্ঠা পেতে থাকে বাংলা গানের ইতিহাসে। ফলে বাংলা গানে একটা গুণগত পরিবর্তন আসতে থাকে। গান হয়ে দাঁড়ায় সহজ সরল, সাহিত্যের সাথে, দর্শনের সাথে বাংলা গানের এতদিনের যোগাযোগ ছিন্ন হতে থাকে।
গানের সুর প্রচলিত রীতিকে পরিত্যাগ করতে শুরু করে, ভালো শোনায় কিনা সেটা হয়ে দাঁড়ায় প্রধান কথা। গীতিকার, সুরকার, গায়ক এই তিনটি বিষয় তিন ব্যক্তিতে ভাগ হয়ে যেতে থাকে। বাংলা গানে যেটা নতুন অভিজ্ঞতা। সেই নতুন গানই আধুনিক বাংলা গান।
বিখ্যাত সুরকার কমল দাশগুপ্ত জানিয়ে ছিলেন যে, এই শ্রেণীর গান রচিত হবার কয়েক বছর পরে তারা কয়েকজনে মিলে এই গীত শ্রেণির নামকরণ করতে গিয়ে এর নাম দেন ‘আধুনিক বাংলা গান।’
তাই আমরা বলতে পারি কালের দিক থেকে ১৯৩০ পরবর্তী চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন কোম্পানি প্রভৃতির সাক্ষাৎ প্রভাবে সৃষ্ট এক প্রকার গানের নাম আধুনিক বাংলা গান। এই গানের সূচনায় যে সকল গীতিকার সুরকার ও গায়ক বিশেষ অবদান রাখেন তাদের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলাম, দিলীপ কুমার রায়, হেমেন্দ্র কুমার রায়, শৈলেন রায়, বাণী কুমার, সুবোধ পুরকায়স্থ, হিমাংশু দত্ত, অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, রাঁইচাদ বড়াল, পংকজ কুমার মল্লিক, কৃষ্ণ চন্দ্র দে, শচীন দেব বর্মণ, কমল দাশ গুপ্ত, যুথিকা রায় প্রমূখের নাম উল্লেখযোগ্য।
লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক, লোকসঙ্গীত শিল্পী।












