চট্টগ্রামের রয়েছে নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি, যেখানে আমার জন্ম

তপন চক্রবর্তী | বুধবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৫ পূর্বাহ্ণ

নদী মেখলা পাহাড়সমুদ্র ও শ্যামলী নিসর্গ বেষ্টিত রম্য চট্টলা। চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার (প্রাক্তন সাতকানিয়া থানার অন্তর্র্গত, বর্তমানে সাতকানিয়া থানা সাতকানিয়া উপজেলা নামে পরিচিত), আমিরাবাদ ইউনিয়নের সুখছড়ি গ্রামে আমার জন্ম। এই জেলার উত্তরে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি জেলা ও ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, পূর্বে বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলা এবং পশ্চিমে নোয়াখালি জেলা ও বঙ্গোপসাগর।

প্রাচীনকাল থেকে কর্ণফুলি নদীর মোহানায় গড়ে ওঠেছিল আন্তর্জাতিক সমুদ্রবন্দর। (কর্ণফুলি নদী নিয়ে গান বেঁধেছিলেন চট্টগ্রামের মলয় ঘোষ দস্তিদার। তাঁর কণ্ঠস্বরের অপূর্ব ধ্বনিমাধুর্যে দর্শকশ্রোতা বিমোহিত হয়ে যেতেন। গানের প্রথম কলি “ছোড ছোড ঢেউ তুলে পানিত, লুসাই পাহাড়তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলি।”) চট্টগ্রাম ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে আরাকান রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর থেকে কখনো আরাকান, কখনো বার্মার অধীনে ছিল। ওখানকার মুসলমানরা রোহিঙ্গা নামে পরিচিত। এরা পশ্চিম রাখাইন রাজ্যের রাষ্ট্রহীন ইন্দোআর্য জনগোষ্ঠী। জনসংখ্যা প্রায় দশলক্ষ। এর মধ্যে কিছু সংখ্যক হিন্দুও ছিল। ১৩৩৮ থেকে ১৫৩৮ সাল পর্যন্ত এই অঞ্চল পর পর কয়েকজন মুসলিম শাসকের অধীনে ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম আবার আরাকান রাজ্যের অধীনে আসে। মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুরা আরাকানদের থেকে চট্টগ্রামকে ছিনিয়ে নেয়। সম্ভবত এই সময়ে বর্গীদের নিয়ে ছড়া রচিত হয়েছিল। মাদাদিরা শিশুকে “বর্গী এলো দেশে” ছড়া শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। ছড়াটি ছিলো এরকম :

খোকা ঘুমাল পাড়া জুড়াল

বর্গি এল দেশে।

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে

খাজনা দিব কিসে?”

ধান ফুরাল, পান ফুরাল

খাজনার উপায় কী?

আর কটা দিন সবুর কর

রসুন বুনেছি।”

মুগলদের চট্টগ্রাম বিজয় পর্যন্ত এই অঞ্চল বর্গীদের দখলেই ছিল। চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন পর্তুগীজদের তৈরি। বর্তমান মাদ্রাসা পাহাড়ের উপর সরকারি মহসিন কলেজের পাশে পর্তুগীজ আমলে নির্মিত প্রায় দুই শত বর্ষী চার তলা উঁচু পরিত্যক্ত প্রাসাদটিই দারুল আদালত। প্রাসাদের নিচে একটি সুড়ঙ্গ ছিল। সুড়ঙ্গটি কর্ণফুলি নদী পর্যন্ত বিস্তৃত। দস্যুরা সুড়ঙ্গ পথে লুটের মাল এনে জমাতো। ঘোড়শ শতকে মোগলরা চট্টগ্রামকে মগ ও পর্তুগীজদের কবল থেকে ছিনিয়ে নেয় এবং চট্টগ্রামের নাম দেন ইসলামাবাদ।

চট্টগ্রাম বহু জাতিকে আতিথ্যদান করেছে এবং সমৃদ্ধ গৌরব অর্জনে করেছে। বিশ্বকবির ভাষায়

…“হেথায় আর্য, হেথা অনার্য

হেথায় দ্রাবিড়, চীন

শকহুনদল পাঠান মোগল

এক দেহে হল লীন।…”

ব্রিটিশের অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য চট্টগ্রাম বিশ শতকে বিশ্বে এক অনন্য গৌরবের আসনে বসেছিল। অনুশীলনী সমিতি এর উদ্যোক্তা। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে ৬৫ জন বিপ্লবী ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাত দশটায় নানা ভাগে ভাগ হয়ে চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইনের অস্ত্রশস্ত্র দখলের জন্য আক্রমণ করেন। শেষ রাতে অস্ত্রাগারের সন্ধান পান এবং অস্ত্র গোলা বারুদ আয়ত্তে নেন। এর মধ্যে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন বিপ্লবী আত্মাহুতি দেন। রাত ভোর হওয়ার আগে বিপ্লবীরা অভিযানের নেতা মাস্টারদা সূর্য সেনকে স্যালুট জানিয়ে ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। কিন্তু সেদিন সময়াভাবে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণের পরিকল্পনা ত্যাগ করতে হয়। ব্রিটিশের বিরুদ্ধে এটি ছিল উপমহাদেশে প্রথম সশস্ত্র সংগ্রাম।

বিপ্লবীরা ভোরে জালালাবাদ পাহাড়ে আত্মগোপন করেন। জানতে পেরে কয়েক হাজার ব্রিটিশ সেনা পুরো পাহাড়ের চারদিক ঘিরে ফেলে। প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়। শতের ওপর ব্রিটিশ সেনা মারা যায়। বিপ্লবীদেরও অনেকে মারা পড়েন। মাস্টারদা সহ বেশ কিছু বিপ্লবী পালিয়ে গ্রামে আশ্রয় নেন। তাঁরা আবার সংঘটিত হন । এবার প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের নেতৃত্বে ইউরোপীয়ান ক্লাবে রাখা অস্ত্রভাণ্ডার দখলের পরিকল্পনা করা হয়। তাঁরা ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণ করেন। কিন্তু তাঁরা অসফল হন। প্রীতিলতার সাথীরা অনেকে মারা পড়েন। বীর প্রীতিলতা ব্রিটিশের হাতে বন্দি হওয়া রোধে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। প্রীতিলতাই ব্রিটিশ ভারতের প্রথম নারী শহীদ। শহীদ হওয়ার আগে তিনি কলকাতা বেথুন কলেজের ছাত্রী ছিলেন। স্কুলে পড়ার সময় জানতে পারেন মায়ের ছোট আপন জ্যাঠাতো বোন চারুবালা চক্রবর্তীও বিপ্লবী দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৩৩ সালে মাস্টারদাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়।

৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সংঘটিত আন্দোলনে ঢাকায় নিরস্ত্র জনগণের উপর পাক বাহিনির গুলিবর্ষণে সালাম জব্বার রফিক সহ অনেকে নিহত ও আহত হয়েছিলেন। এতে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ক্ষোভে ফেটে পড়েছিল। চট্টগ্রাম এই ক্ষেত্রেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ভাষার জন্য সংগ্রামে যে গণহত্যা হয়েছিল তার প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তানে প্রথম কবিতা রচনা করেছিলেন চট্টগ্রামের কবি চৌধুরী মাহবুব উল আলম। কবিতার শিরোনাম ছিল“কাঁদতে আসিনি, ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছি।”

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধেও চট্ট্রগ্রামের সমৃদ্ধ সংগ্রামী অবদান রয়েছে। সেই সময় মুক্তিযোদ্ধা বেলাল মোহাম্মদ চট্টগ্রাম বেতারে কর্মরত অবস্থায় ২৬ মার্চ সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে তাঁর আরো কয়জন সহকর্মী মিলে কালুরঘাটের বেতার স্টেশনে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এই বেতারকেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন জানা যায়। পরে বেতারযন্ত্রটিকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম সেনানিবাস ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সহ সর্বস্তরের সেনা ও পুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষকবৃন্দ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও ছাত্রবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন।

চট্টগ্রামের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। চট্টগ্রামের ভাষার নাম চাটগাঁইয়া। লক্ষ করবেন চট্টগ্রামের দুটো লোক মিলিত হলে আঞ্চলিক ভাষাতেই কথোপকথন করেন। চাটগাঁইয়া গান, নাটক, গালি, রসিকতা সবই অন্যজেলার লোকের কাছে দুর্বোধ্য। চাটগাঁইয়ারা কিন্তু তাঁদের ভাষার জন্য গর্ববোধ করে। চট্টগ্রামের বহু মনীষী বাংলাদেশের সাহিত্যে, শিল্পে, নৃত্যে, সঙ্গীতে সমীহ করার মতো অবদান রেখেছেন ও রেখে চলেছেন। সুরকার এম. এন. আখতার, শেফালী ঘোষ ও শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের গান আজো লোকের মুখে মুখে ফিরে। কিংবদন্তি কবিয়াল রমেশ শীল শুধু চট্টগ্রাম নয়, বাঙালির সম্পদ।

চট্টগ্রামের অনন্য বৈশিষ্ট্য দেশভাগের পর থেকে বহু অঞ্চলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট ছিল এবং এখনো আছে। অর্থবিত্তের জন্য দাঙ্গাহাঙ্গামা যা হয়েছে তাতে ইন্ধন যুগিয়েছে অন্য জেলার লোক এবং তার অধিকাংশই শহরকেন্দ্রিক।

চট্টগ্রামে বহু ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পত্রপত্রিকা, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এসব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান সারা বছর বহু ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড সম্পন্ন করে। পর্যটন শিল্পেও চট্টগ্রামের উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। ব্রিটিশের পরীর পাহাড়ে ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠিত আদালত ভবন, সাত রাস্তার মোড়ে, টাইগার পাসে ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ নির্মিত পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং ,পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, চন্দ্রনাথ ধাম, বায়েজিদ বোস্তামীর দরগাহর শত বর্ষী কচ্ছপ, কাপ্তাই হ্রদ, ফয়েজ লেক, চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য সহ বহু দর্শনীয় স্থান রয়েছে।

লোহাগাড়া (প্রাক্তন সাতকানিয়া থানার দক্ষিণাংশ) উপজেলা চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের মধ্যে অবস্থিত। এটি বাংলাদেশের বৃহত্তম ও ঘনবসতিপূর্ণ উপজেলা। কথিত আছে, ১৬৬০ সালে মুঘল যুবরাজ শাহ সুজা আরাকান রাজ্যে পালানোর সময় চুনতি গ্রামের পাহাড়ে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়েছিলেন। চলে যাওয়ার সময় তিনি একটি লৌহদণ্ড পুঁতেছিলেন। লোহাগাড়া নামের ব্যুৎপত্তি হয়তো এ কারণেই হয়েছিল। লোহাগাড়ার উত্তরে সাতকানিয়া, দক্ষিণে চকরিয়া ও লামা উপজেলা, পূর্বে বান্দরবান সদর ও লামা উপজেলা ও পশ্চিমে বাঁশখালি উপজেলা। এর প্রধান নদী টঙ্কাবতী ও ডলু এবং খালের মধ্যে রয়েছে হাঙ্গর, হাতিয়া, রাতার ও বোয়ালিয়া।

টঙ্কাবতী নদী সুখছড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। বান্দরবানের টঙ্কাবতী ইউনিয়নের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এই নদীর উৎপত্তি। এটি দৈর্ঘ্যে ৫৩ কিলোমিটার এবং প্রস্থে ৪৬ সেন্টিমিটার। শুখা মৌসুমে নদী হেঁটে পার হওয়া যায়। বর্ষায় এর তাণ্ডব দেখার মতো। জল মিষ্টি। সারা বছর ছোট, বড় মাছ পাওয়া যায়। এর শেষাংশের নাম ডলু যা সাঙ্গু নদীর সঙ্গে মিশে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।। খালগুলো বর্ষার জল ও পাহাড়ের জলে ফুলে ওঠে। বর্ষার শেষে খালের জল সেঁচে রবিশস্যের চাষ করা হয়। সুখছড়ির পূর্বে পুটিবিলা, পশ্চিমে আমিরাবাদ, উত্তরে হাজারিবাগ ও দক্ষিণে কলাউজান। সুখছড়ির অনেকে পারিবারিক বনায়ন গড়ে তুলেছেন। পূর্ব দিকে তাকালে বান্দরবানের পাহাড় শ্রেণির অপরূপ দৃশ্য মনকে উদাস করে। পাহাড়ের পেছন থেকে সূর্য উঠার দৃশ্য খুবই মনোরম। বিশেষ করে শীতকালে কুয়াশার চাদর ফুঁড়ে অর্কদেবের করুণা অর্ধনগ্ন বালক বালিকাদের জন্য আশিসস্বরূপ।

লেখক : সাহিত্যিক, বিজ্ঞান লেখক, শিক্ষাবিদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধমানবাধিকার, শ্রমের মর্যাদা ও সহিংসতামুক্ত কর্মপরিবেশ প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধকর্ণফুলীতে দুই মাদক বিক্রেতা গ্রেপ্তার