চর্যাপদ : বাংলার হাজার বছরের ভাষা, দর্শন ও আত্মপরিচয়ের প্রথম দরজা

পুলক কান্তি বড়ুয়া | বুধবার , ১০ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির জন্মলগ্নে ফিরে তাকাতে চাইলে যে নামটি প্রথম আলো হয়ে ভেসে ওঠে, তা হলো চর্যাপদ। এটি শুধু কয়েকটি প্রাচীন গানের সংকলন নয়, বরং বাঙালির ভাষা, সংস্কৃতি, আধ্যাত্মিক চিন্তা ও লোকজ জীবনকে বোঝার প্রাচীনতম জানালা। প্রায় এক হাজার বছর আগের এই গানগুলি আজও প্রাসঙ্গিক থাকে এই সত্যটিই প্রমাণ করে, চর্যাপদ কেবল অতীতের নিদর্শন নয়, এটি বাঙালির আত্মপরিচয়ের ভিত্তি।

চর্যাপদ আসলে কী?: চর্যাপদ হলো বৌদ্ধ সাহজ্যান বা সহজিয়া সাধকদের রচিত আধ্যাত্মিক গান। ভাষায় এটি আপভ্রংশ, প্রাকৃত ও প্রাচীন বাংলার একটি সংমিশ্র রূপ; তাই বাংলা ভাষার মূলধারা কোথা থেকে উঠে এসেছে, তার প্রথম প্রমাণ চর্যাপদেই পাওয়া যায়। গবেষকদের মধ্যে কিছু মতভেদ থাকলেও এ বিষয়ে প্রায় সবাই একমত যে চর্যাপদ বাংলা ভাষার প্রাচীন স্তরকে সবচেয়ে স্পষ্টভাবে ধারণ করে।

প্রাসঙ্গিকতা কোথায়?: চর্যাপদের ভাষা, রূপক আর দৃষ্টি আজও সমান মূল্যবান। এর গূঢ় প্রতীকী ভাষায় রহস্য আছে, কিন্তু সেই ভাষার ভেতরই মানুষের জীবনসংগ্রাম, আকাঙ্ক্ষা, ভয়, দুঃখ এবং মুক্তির আর্তি ধরা পড়ে। নদী, নৌকা, মৌচাক, ডোম্বী, কৃষিজীবন এসব চিত্র দেখায় যে বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজ ও লোকজ সংস্কৃতি তখনই একটি স্পষ্ট রূপ নিতে শুরু করেছিল। আধুনিক ভাষাতত্ত্ব, সমাজসংস্কৃতির ইতিহাস এবং লোকজ জীবন অধ্যয়নে তাই চর্যাপদ আজও নির্ভরযোগ্য ভিত্তি।

বাঙালির নিজস্ব দর্শন হিসেবে চর্যাপদ: চর্যাকবিরা দেহ, মন এবং মুক্তিকে ব্যাখ্যা করতে ব্যবহার করেছেন কৃষিকাজ, ভ্রমণ, শিকার, নদীযাত্রা এইসব সহজ অভিজ্ঞতা। এর ভেতরে যে দর্শন ফুটে ওঠে, তা আজকের মরমি বাউল দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আশ্চর্যভাবে মিলে যায়। দেহকে সাধনার ক্ষেত্র, মানুষকে সত্যের দরজা, অন্তরের মানুষকে উদ্ধার করার পথ এই ভাবনাগুলো চর্যাপদ থেকে বাউল দর্শন পর্যন্ত একটি দীর্ঘ সাংস্কৃতিক সেতু তৈরি করেছে। যদিও এটি সরাসরি প্রমাণ করা যায় না, তবু দৃষ্টিভঙ্গির মিল এতটাই স্পষ্ট যে ইতিহাস তার ইঙ্গিতকে অস্বীকার করতে পারে না।

বাউল গান ও চর্যাগীতির ছায়া: বাউলরা গান করেন মানুষের ভেতরের মানুষকে খুঁজে পাওয়ার কথা। তারা দেহতত্ত্বকে উপমায় ব্যাখ্যা করেন, নদী, নৌকা, মাঝি, পাখি, পথ সবই হয়ে ওঠে অন্তর্জগতের প্রতীক। চর্যাপদের ভাষা ও বাউল গানের এই প্রতীকী ভাষা এক ধরনের অভিন্ন আধ্যাত্মিক ঐতিহ্যকে সামনে আনে। দু’টি ধারাই বলে, সত্য বাইরে নয়; মানুষের ভিতরেই মুক্তির চাবি লুকানো।

গবেষকদের প্রয়োজনীয় কাজ: চর্যাপদকে প্রজন্মের কাছে সহজভাবে তুলে ধরতে হলে গবেষকদের কাজ হতে হবে দ্বিমুখী।

একদিকে প্রয়োজন ভাষা, প্রতীক ও দেহতত্ত্বের গভীর একাডেমিক গবেষণা। অন্যদিকে দরকার সহজ ভাষায় ব্যাখ্যা, গল্পভিত্তিক ব্যাখ্যা, সংগীতায়ন, নাট্যরূপ, গ্রাফিক্স ও ডকুমেন্টারি যাতে সাধারণ মানুষ চর্যাকে বুঝতে পারে ভয় নয়, আনন্দ নিয়ে।

চর্যার প্রচার শুধু পাঠ্যপুস্তকে থাকা নয়; প্রয়োজন ডিজিটাল মাধ্যম, অডিওভিজ্যুয়াল কনটেন্ট, অনলাইন লেকচার সিরিজ, বাউল ও লোকসংগীতের সঙ্গে সমন্বিত পরিবেশনা। গবেষকদের দায়িত্ব থাকবে চর্যাকে ভুল ব্যাখ্যা থেকে রক্ষা করা এবং এর বহুস্তরীয় সত্যকে শ্রদ্ধার সঙ্গে তুলে ধরা।

বাংলার সংস্কৃতি বিশ্বদরবারে তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা: পৃথিবীর প্রতিটি জাতি তাদের ভাষা, পুরাণ, গান ও দর্শনকে তুলে ধরে নিজস্ব পরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে। গ্রীকরা হোমারকে, ভারত তাদের বেদউপনিষদকে, চীনারা তাও দর্শনকে, জাপান নো থিয়েটারকে বিশ্বমঞ্চে উপস্থাপন করেছে। বাংলার পরিচয়ের প্রথম গ্রন্থ যদি চর্যাপদ হয়, তবে বিশ্বদরবারে আমাদের পরিচয়ের প্রথম দরজাও এটিই। চর্যাকবিরা যে আধ্যাত্মিক মানবতাবাদ ও সরল সত্য খুঁজেছিলেন, তা আজও বিশ্বসমাজে প্রাসঙ্গিক। তাই চর্যাপদ ও বাউল দর্শনকে আন্তর্জাতিকভাবে তুলে ধরা মানে বাঙালির নিজস্ব বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্যকে সম্মানের স্থান দেওয়া।

হাজার বছরের পুরোনো চর্যাপদ কেবল অতীতের একটি বই নয়; এটি বাঙালির ভাষার ভোর, সংস্কৃতির শিকড়, দর্শনের দিগন্ত। আজ যখন পৃথিবী নিজের পরিচয়কে পুনর্গঠনের পথে, তখন আমাদেরও জরুরি নিজের উৎসের দিকে ফিরে দেখা। চর্যাপদ সেই উৎসের প্রথম জল। এই জলকে আজকের তরুণ পাঠকের সামনে তুলে ধরা শুধু প্রয়োজন নয়, এটি আমাদের সাংস্কৃতিক দায়িত্বও।

লেখক: প্রাবন্ধিক, কবি, প্রকৌশলী ও উদ্যোক্তা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমানবাধিকার, শ্রমের মর্যাদা ও সহিংসতামুক্ত কর্মপরিবেশ প্রসঙ্গে