গাজা এবং ইউক্রেন একটি আরব উপদ্দীপের অপরটি ইউরোপীয় ভূ–খণ্ড। দুটি অঞ্চলই যুদ্ধের যাতাকলে ধ্বংসপ্রাপ্ত প্রায়। দুটি যুদ্ধ শুরু হয় দুটি ভিন্ন প্রেক্ষাপটে। গাজার যুদ্ধ ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘ বঞ্চনা, নিপীড়ন, হত্যা, নির্যাতন, স্বীয় আবাসভূমি থেকে লক্ষ মানুষকে উৎখাত করে শরণার্থী শিবিরে ঠেলে দেওয়ার এক নির্মম দৃশ্যের প্রেক্ষাপটে।
অপরদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপট রচিত হয়েছে পাশ্চাত্য তথা তাদের সামরিক জোট ন্যাটোর ক্রমবর্ধমান রাশিয়া অভিমুখি প্রভাব বিস্তারে ইউক্রেনের জোট বন্ধনজনিত কারণ থেকে।
রাশিয়া নানাভাবে চেষ্টা চালিয়েছে ইউক্রেনকে ন্যাটোর প্রভাব বলয়ে ঝুঁকে পড়া থেকে বিরত রাখতে। অসফল রাশিয়া শেষ পর্যন্ত তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে ইউক্রেনে সামরিক অভিযানে নেমে পড়ে।
অন্যদিকে পৃথিবীর মানবতাবোধ সম্পন্ন এবং সচেতন মানুষেরা ফিলিস্তিনে ইসরাইলী বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন, প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছেন, অনেকে আত্মাহুতিও দিয়েছেন। কিন্ত্তু ইসরাইল কোন কিছুতেই কর্ণপাত করেনি। এর পেছনের কারণ আমেরিকার ইসরাইলের সমস্ত মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের প্রতি অকুণ্ঠ সর্মথন। এ সমর্থন সামরিক, কূটনৈতিক এবং আর্থিক র্স্বক্ষেত্রে।
স্কুল এবং কলেজ জীবনে পরীক্ষার খাতায় বহুবার দুটি সমার্থক বা পরস্পর বিপরীত জিনিসের পার্থক্য লিখেছি, যেমন জীব ও জড়ের মধ্য পার্থক্য, এসব বিষয় পরীক্ষার খাতায় লিখলেও মনের খাতায় তেমন কোন প্রভাব ফেলেনি। জীবনে চলতে গিয়ে পরবর্তীতে সমাজের ধনী গরীবের পার্থক্য মনকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। বর্তমানে পৃথিবীর পরাশক্তি সমূহের সাধারণ দেশগুলির প্রতি বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির প্রতি নির্মম দমন, পক্ষপাতমূলক আচরণ এবং এবং শোষণ অবলোকন করে নিজের মাঝে অসহায়ত্ব বোধই কেবল বিস্তার করে চলেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক বিশ্বের অন্যতম দুটি শান্তি উদ্যোগ নিয়ে পার্থক্যের বিষয়গুলি তুলে ধরব বলে এই লেখার অবতারণা। বলাবাহুল্য দুটি উদ্যোগই আমেরিকার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। আমেরিকা ইসরাইলকে অস্ত্র দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে ফিলিস্তিনে তথায় গাজায় বেপরোয়া নিরস্ত্র মানুষ হত্যায়। আমেরিকা ইউক্রেনকে অস্ত্র দিয়েছে, অর্থ দিয়েছে কূটনৈতিক সমর্থন দিয়েছে রাশিয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্য। আমেরিকা ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় ইসরাইলকে নিবৃত্ত করতে তার উপর কোন অবরোধ আরোপ করেনি। আমেরিকা ইউক্রেনকে রক্ষায় রাশিয়াকে নিবৃত্ত করতে তার উপর কঠোর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছে। আমেরিকা ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় ইসরাইলকে নিবৃত্ত করতে তার কোনও সম্পদ জব্দ করেনি বরং আরো আরো সম্পদের যোগান দিয়েছে। আমেরিকা ইউক্রেনকে রক্ষায় রাশিয়াকে নিবৃত্ত করতে তার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের সম্পদ জব্দ করেছে, এমনকি আমেরিকার প্রভাবে ইউরোপিয় ইউনিয়নও রাশিয়ার কয়েকশত বিলিয়ন ডলার জব্দ করেছে। ‘গণহত্যা আর ধ্বংসলীলার বিচারবিহীন গাজা শান্তি চুক্তি’ এই শিরোনামে গাজা শান্তি চুক্তির উপর ইতিপূর্বে আমি আলোচনা করেছিলাম। বিচারহীন গাজা চুক্তি কথাটি উল্লেখ করেছিলাম অনেকটা ক্ষোভ উৎসারিত থেকে আর বর্তমান গাজার অবস্থা পরিদৃষ্টে অন্তরে বেদনার সাথে পরাশক্তিগুলির প্রতি ঘৃণাও জন্মাচ্ছে। গাজায় এখনও দখলদারিত্ব বজায় আছে। মানুষকে এখনও ভাস্ত্তুভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হচ্ছে। ফিলিস্তিনিদের এখনও তার কষ্ট জন্মানো ফসলের মাঠে প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না, তাদের ফসল লুন্ঠিত হচ্ছে সাথে ফসলের মাঠও। এ অন্যায় এ বর্বরতা ফিলিস্তিনিদের উপর সুদীর্ঘ কাল থেকে চলমান। গাজায় সব কিছু যখন বিধ্বস্ত, গাজা যখন বিরানভূমি, লক্ষ মানুষ যখন হন্তারক সময়ের কবলে তখন গাজা শান্তি চুক্তির অবকাশ পায় বিশ্ব। সে শান্তি চুক্তিও এখন নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতার বাতাবরণে। আজকের আলোচনায় প্রথমত পাঠকদের সামনে আমি প্রস্তাবিত ইউক্রেন শান্তি চুক্তি’র বিষয়টি তুলে ধরে দুটি চুক্তিতে আমেরিকানদের দ্বি চারিতার তথা দ্বিমুখি আচরণের বিষয়গুলি পাঠকদের সামনে তুলে ধরার প্রয়াস পাব।
প্রস্তাবিত ইউক্রেন শান্তি চুক্তি
১। ইউক্রেনের সার্বভৌমত্বের নিশ্চিতা প্রদান করা হবে। ২। বিগত ৩০ (তিরিশ) বছরের নানা বিরোধ বিসংবাদ পিছনে রেখে ইউক্রেন রাশিয়া এবং ইউরোপের মধ্যে একটি সার্বিক অনাক্রমণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। ৩। রাশিয়া প্রতিবেশী দেশগুলির উপর অভিযান পরিচালনা করে দখল করে নিবে না, ন্যাটো তার আর কোনও প্রভাব বিস্তারে ব্রতী বা উদ্যোগী হবে না। ৪। ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে আমেরিকার উদ্যোগে কার্যকর সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে যার ফলে সংঘাত পরিহার করে ভূ–নিরাপত্তা নিশ্চয়তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জিত হবে। ৫। ইউক্রেনকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রদান করা হবে। ৬। ইউক্রেন সামরিক বাহিনীর শক্তি ৬০০০০০ (ছয় লক্ষ) এর মাঝে সীমাবদ্ধ রাখা হবে। ৭। ন্যাটো’তে যোগদান করবে না এ বিষয়টি ইউক্রেন সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করবে, ন্যাটো কখনো ইউক্রেনকে তাদের সদস্যভুক্ত করবে না এ অঙ্গীকার ব্যক্ত করবে। ৮। ন্যাটো ইউক্রেনে কোন সৈন্য মোতায়েন করবে না। ৯। ইউরোপিয় যুদ্ধ বিমান সমূহ পোল্যান্ডে অবস্থান করতে পারবে। ১০। আমেরিকা এই শান্তিচুক্তির জিম্মাদার হিসাবে নিজেকে সরিয়ে নেবে যদি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করে, একই সাথে প্রত্যাহৃত সকল অবরোধ পুনরায় আরোপ করা হবে এবং রাশিয়ার কাছে হস্তান্তরকৃত অঞ্চল সমূহ তা করা হয়নি বলে বিবেচিত হবে আর ইউক্রেন যদি রাশিয়া অভিমুখে কোন মিসাইল আক্রমণ পরিচালনা করে তবে ইউক্রেনকে দেওয়া নিরাপত্তা নিশ্চয়তা প্রত্যাহৃত বলে বিবেচনা করা হবে। ১১। ইউক্রেন ইউরোপিয় ইউনিয়নে যোগ দিতে পারবে। এক্ষেত্রে ইউরোপিয় বাজারে ইউক্রেন স্বল্পকালীন অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা পাবে। ১২। ইউক্রেনের উন্নয়নে একটি ফান্ড গঠন করা হবে যা থেকে – শিল্প উন্নয়ন, প্রকৌশল গত উন্নয়ন, আর্টিফিসিয়াল বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেেত্ের বিনিয়োগ করা হবে। আমেরিকার সহায়তায় ইউক্রেনের গ্যাস ক্ষেত্রের সার্বিক উন্নয়ন সাধন করা হবে, যুদ্ধ বিধ্বস্ত অঞ্চল সমূহ দ্রুত পুনর্বাসনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, অবকাঠামো সমূহের দ্রুত উন্নয়ন ঘটানো হবে, খনিজ এবং প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হবে। এ সমস্ত উদ্যোগ বাস্তবায়নে বিশ্ব ব্যাংক একটি অর্থনৈতিক প্যাকেজ অনুমোদন করবে। ১৩। রাশিয়াকে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সম্পৃক্ত করা হবে। এক্ষেত্রে ধাপে ধাপে আলোচনার মাধ্যমে অবরোধ সমূহের অবসায়ন করা হবে। রাশিয়ার সাথে আমেরিকা নানা ক্ষেত্রে বিশেষ করে জ্বালানী, প্রাকৃতিক সম্পদ, অবকাঠামো, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, আর্কটিক অঞ্চলে অতি দুর্লভ খনিজ আহরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে দীর্ঘ মেয়াদি সহযোগিতা চুক্তিতে আবদ্ধ হবে। রাশিয়াকে জি–৮ এ যোগদানের আমন্ত্রণও জানানো হবে। ১৪। অবরুদ্ধ সম্পদ। রাশিয়ার ১০০ (একশত) বিলিয়ন ডলার ইউক্রেনের পুনঃনির্মাণ এবং বিনিয়োগে ব্যবহৃত হবে। এ বিনোয়েগের ৫০% লভ্যাংশ আমেরিকা পাবে। ইউক্রেনের পুনর্গঠনে ইউরোপিয়রাও ১০০ (একশত) বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করবে। রাশিয়ান অবশিষ্ট অবরুদ্ধ অর্থ রাশিয়া আমেরিকার যৌথ প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। এ বিনিয়োগ এমন উদ্দেশ্যে করা হবে যা ভবিষ্যতএ সংঘাত সংঘর্ষ পরিহারে উৎসাহিত করবে। ১৫। রাশিয়া – আমেরিকার মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হবে, যা এ চুক্তি বাস্তবায়নে কাজ করবে। ১৬। রাশিয়া ইউরোপ ইউক্রেনে আক্রমণাত্বক অভিযান পরিচালনা করবে না। ১৭। রাশিয়া এবং আমেরিকা পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধিতে সম্মত হবে এবং এক্ষেত্রে যৌথভাবে কাজ করবে, স্টার্ট–১ চুক্তিও এর মাঝে অন্তর্ভূক্ত থাকবে। ১৮। ইউক্রেন পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির আওতায় পারমানবিক অস্ত্র মুক্ত দেশ হিসাবে গণ্য হবে। ১৯। জাপোরিজিয়া পারমানবিক শক্তি কেন্দ্র, আন্তর্জাতিক পারমানবিক এ্যানার্জি এ্যাসোসিয়েশেনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হবে। এখানে উৎপাদিত জ্বালানি রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে সমান সমান ভাবে বন্টন করা হবে। ২০। রাশিয়া এবং ইউক্রেন উভয় দেশের বিদ্যালয় সমূহ এবং সামাজিক সংস্থা সমূহ তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে পারস্পরিক বিদ্বেষ দূর করার, জাতিগত ভেদাভেদ ভুলার এবং সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে ইউক্রেন ইউরোপে প্রচলিত ধর্মীয় সহনশীলতার আইন কানুন, ভাষা এবং জাতিগত ক্ষুদ্র জনসমষ্টি সমূহকে নিরাপত্তা প্রদানের নীতি অনুসরণ করবে। উভয় দেশ নিপীড়নমূলক আইন সমূহ বিলুপ্ত করে শিক্ষা এবং সংবাদ পত্র সমূহের স্বাধীনতা নিশ্চিত করবে। উভয় দেশ নাৎসীবাদকে নিবারণ, পরিহার এবং নিরুৎসাহিত করবে। (চলবে)
লেখক: প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।









