সমপ্রতি হাতে এলো কথাশিল্পী কাসেম আলী রানা‘র চতুর্থ কিশোর উপন্যাস ‘কালো পুতুল’। ‘কালো পুতুল’–এ আমাদের সমাজের বিপথগামী হাজার হাজার কিশোরের প্রতীক রাজের স্বীকারূক্তি তাই বলে। রাজ নিজের জীবন সম্পর্কে বলে, ‘স্যার আমার জন্ম কীভাবে হয়েছে, কোথায় হয়েছে, কে আমার মা–বাবা, কোথায় তারা, বেঁচে আছে, নাকি মরে গেছে, তার কোনো কিছুই আমি জানি না। তবে এইটুকু জানি আমি এলিট শ্রেণির মানুষের লাথি উষ্ঠা খেতে খেতে এই খাল পাড়ের বস্তিতে এসে পড়েছি। এ বয়স অবধি কারো কাছ থেকে মানুষের বাচ্চা হিসেবে আদর ভালোবাসা পাইনি। প্রয়োজনে শুধু ব্যবহার হয়েছি। কেমন করে আমি ওইসব অন্ধকার জগতে এসে জড়িয়ে পড়লাম জানি না‘
কিশোর রাফি, জয়, রাজ এই তিন কিশোর এবং বিজ্ঞানী ড. হামদাদ খানকে নিয়ে আবর্তিত হয়েছে ‘কালো পুতুল’ উপন্যাসের কাহিনি। স্কুলে যাওয়ার পথে রাফির সাথে পরিচয় ঘটে বস্তির ছেলে জয়ের। জয় তার মায়ের সাথে বস্তিতে থাকে। তাদের নিত্য অনটন। জয়ের উপোস থাকার কথা শুনে রাফি সহমর্মী হয়ে উঠে। তার স্কুলের টিফিন জয়কে দিয়ে দেয়। রাফি মাকে বলে ভালো ভালো খাবার বানিয়ে সে খাবার জয়ের হাতে তুলে দিতো। জয় তৃপ্তি সহকারে খেতো। এভাবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। অন্যদিকে জয় যে বস্তিতে থাকে সেই খালপাড় বস্তির ছেলে রাজ কিশোর গ্যাঙ লিডার। তার ভয়ে সদা তটস্থ মসজিদের খাদেমসহ এলাকার জনগণ। একদিন রাজ জয়কে ডেকে পাঠায়। কিন্তু জয় তার ডাকে সাড়া না দেওয়ায় একদিন তার চামচাদের দ্বারা জয়কে ধরে নিয়ে যায়।
গ্যাঙ লিডার রাজের নির্দেশে তার চামচারা জয়ের ওপর নির্মম নির্যাতন চালায়। নিষ্ঠুর নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে জয় রাজকে বিনীতভাবে বলে, ‘রাজ ভাই আমাকে ছেড়ে দিন। আমি মায়ের কাছে যাব।’ রাজ বলল, ‘তাকে ছাড়তে পারে একটি শর্তে।’ জয় বলল, ‘কী শর্ত ভাই?’ রাজ বলল, ‘তোকে একটা বোমা দেয়া হবে। সাথে ২০০০ টাকা। টাকা দিয়ে চিকিৎসা করবি।’ ‘আর বোমাটা কী করব?’ জানতে চাইল জয়। রাজ বলল, ‘বোমাটা দূর থেকে রাফির গায়ে মারবি। যাতে রাফি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।’ রাজের এ কথায় জয় চিৎকার করে বলল, তার দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। রাফি তার খুবই প্রিয় বন্ধু। এমন বন্ধুকে কেউ হত্যা করতে পারে না। ভয়ংকর নির্যাতনে একসময় জয় রাজি হয়।
রাফির সাথে রাজের কোনো একটা বিষয়ে বিরোধ হয়েছিল। সেই থেকে রাজ রাফিকে হত্যার সুযোগ খুঁজছিল। ‘এখন ঘড়ির কাঁটায় একটা পঞ্চাশ মিনিট। আর দশ মিনিট পর রাফির স্কুল ছুটি। জয় স্কুল গেটের অপর প্রান্তে এক শতবর্ষী কড়াই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। প্রায় পাঁচ হাত দূরে জয়কে পাহারা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রাজের চামচা খোকন এবং আরো চারজন। জয় অপেক্ষা করতে করতে ভাবে, রাফি তার পরম বন্ধু। তাঁর ক্ষুধায় সে খাবার যুগিয়েছে। এমন বন্ধুকে খুন করা চরম অকৃতজ্ঞতা। এরইমধ্যে স্কুল ছুটি হয়। রাফি স্কুল থেকে বের হলো। রাফি কাঁপা কাঁপা হাতে বোমাটি উঁচু করে ধরল। এমন সময় রাফি গাড়িতে উঠে পড়ল এবং চোখের পলকে আড়াল হয়ে গেল। আর বোমাটি কম্পমান হাত ফসকে জয়ের পায়ের কাছে পড়ে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলো এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল জয়। তার শরীরের নিচের অংশ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। পরদিন খালপাড় বস্তি থেকে গ্রেপ্তার হয় রাজ, তার অন্য সাঙ্গপাঙ্গরা। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় কিশোর গ্যাঙের আস্তানা।
জয়ের আকস্মিক মৃত্যুতে প্রচণ্ডভাবে ভেঙে পড়ে রাফি। জ্বরের পর জ্বরে কাবু হয়ে পড়ে সে। দেশের খ্যাতনামা চিকিৎসকদের পরামর্শমতো যত টেস্ট প্রয়োজন সব করেন তার মা–বাবা। কিন্তু জ্বর ১০৫ ডিগ্রি থেকে নামেই না। শেষে নিয়ে যাওয়া হয় বিদেশে। সেখানেও বড় বড় বিশেষজ্ঞ কর্তৃক পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হয়। সেখানেও তার শরীরে কোনো রোগ খুঁজে পাওয়া যায়নি। শেষে একজন সাইকোলজিস্টিক দেখানো হয়। তিনিও অভিন্ন অভিমত দিলেন, রাফি স্বাভাবিক, সুস্থ একজন কিশোর। অনেকটা হতাশা নিয়ে রাফির মা–বাবা দেশে ফিরে আসলেন।
এরই মধ্যে রাশিয়ায় একটি সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে দেশে ফিরে আসেন ড. হামদাদ খান। তিনি রাফির অসুস্থতার কথা শোনে হতবাক হয়ে পড়েন। রাফির অসুস্থতার কারণের যখন কূলকিনারা করে উঠতে পারছিলেন না তখন ড. হামদাদ খানের চোখে পড়ে রাফির হাতে একটি খেলনা পুতুল। ‘কালো পুতুল’। তিনি পুতুলটির উৎস জানতে চাইলে রাফি তাঁকে জানান এটি জয়ের কবরে একটি মাটির দলার মধ্যে পেয়েছিল। ড. হামদাদ খান ‘কালো পুতুল’ নিয়ে ভাবতে থাকেন। তিনি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন খালপাড় বস্তি, খবর নেন জয়ের মায়ের। কথা বলেন মসজিদের খাদেমের। দেখতে যান জয়ের কবর। ড. হামদাদ খান বুঝতে পারেন এই পুতুল স্বাভাবিক কোনো পুতুল নয়। খেলনা পুতুল দেখতে রঙিন হয়। কিন্তু এটি কালো। তিনি নেমে পড়েন ‘কালো পুতুল’–এর রহস্য উন্মোচনে। মগ্নপ্রাণ পাঠক ‘কালো পুতুল’ শেষাবধি পড়া হলে রহস্য খুঁজে পাবেন।
বহুমাত্রিক লেখক কাসেম আলী রানার এই উপন্যাসটির নামকরণে রহস্যের ছোঁয়া থাকলেও এটি একটি নিখাদ সামাজিক উপন্যাস। কিশোর অপরাধ প্রবণতা বিশেষত কিশোর গ্যাঙ নিয়ে লেখক যেভাবে ভেবেছেন, কলমের তুলিতে জীবন্ত করে তুলেছেন তারজন্য তাঁকে সাধুবাদ জানাতেই হয়। তবে কিশোর উপন্যাস হিসেবে তাঁর কিছু কিছু সংলাপ এবং বর্ণনা কিশোর উপযোগী মনে হয়নি। বিশেষ করে জয়ের ওপর নির্যাতনের যে চিত্র তিনি এঁকেছেন তা পাঠকের ভালো লাগার কথা নয়। সে সাথে কিশোর রাফির রোগ–শোকের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি যে সংলাপ সাজিয়েছেন তাতে পাঠক গল্প পড়ার চেয়ে চোখের জলই ফেলবেন বেশি। প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই লিখেছিলেন, ‘শিশুকিশোর সাহিত্য মানে জীবনের জয়গান গাওয়া—মৃত্যুর নয়।’ আমরা যারা ছোটদের সাহিত্য নিয়ে কাজ করি আমাদের এই বিষয়টি মনে রাখা প্রয়োজন বলে মনে করি। মোমিন উদ্দীন খালেদ–এর চমৎকার প্রচ্ছদে বারোটি পর্বে বিভক্ত ৯৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছে শৈলী প্রকাশন থেকে। আমরা উপন্যাসটির পাঠকপ্রিয়তা কামনা করছি।
[মৃত্যুর আগে লেখাটি আমাদের কাছে পাঠিয়েছিলেন প্রয়াত শিশুসাহিত্যিক, ‘আলোর পাতা’ সম্পাদক এমরান চৌধুরী। আমরা তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছি।–সম্পাদক]










