প্রিয় ছড়াশিল্পী, শিশুসাহিত্যিক, আলোর পাতা সম্পাদক এমরান চৌধুরী সবাইকে শোক সাগরে ভাসিয়ে ৫ ডিসেম্বর না ফেরার দেশে চলে গেলেন। ৫ দিন আইসিইইউতে নিবিড় পর্যবক্ষেণে থেকে শুক্রবার দুপুর সাড়ে বারোটায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। যতদূর মনে পড়ে তাকে প্রথম দেখি আশির দশকের শেষের দিকে চট্টগ্রাম বিপনি বিতানে। তিনি মার্কেটের ভেতর দিয়ে জলসা মার্কেটে আরেক কবি বন্ধু খালেদ সরফুদ্দীনের কাছে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ সাদা স্কুল ড্রেসে আমাকে দেখে থমকে দাঁড়ান। হাতে থাকা একটা হলুদ খামে গোটা গোটা বাংলা অক্ষরে আমার নাম লিখলেন ‘জনাব গোফরান উদ্দীন টিটু।‘ আমি তো অবাক! একজন স্কুল বালকের নামেও জনাব! যার পর নাই বিস্মিত আমি। লজ্জায় মুখ লুকাই। এমরান ভাই আমার এলাকায় শাপলা কুঁড়ির আসরের সম্মেলনে আমাকে ছড়া পাঠের আমন্ত্রণ জানান। তিনি জেনে খুশি হন তাদের ছড়ালেখা প্রতিযোগিতায় আমি প্রথম স্থান লাভ করেছি এবং প্রধান অতিথির কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করবো। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। চট্টগ্রাম তথা দেশের পত্রপত্রিকায় ছোটোদের পাতায় আমি তখন ছড়া লিখে বেশ সুপরিচিত। চট্টগ্রামের খ্যাতিমান শিশুসাহিত্যিকদের সঙ্গে তখন আমার সবেমাত্র পরিচয় ঘটছে। এমরান ভাইকে দিয়েই সেদিন তাঁর শুভ সূচনা ঘটলো। সে পরিচয় আজ চার দশক পেরিয়েও বেশ অম্লান ছিলো। এমরান ভাই পরবর্তীতে আমার বেশ কিছু বইয়ের আলোচক ছিলেন। সংবাদপত্রে তিনি চুলচেরা বিশ্লেষণে খুঁটিনাটিসহ বিস্তারিত আলোচনা করতেন। আমি তার ‘চিকনখোলার ভূত’সহ কয়েকটি বইয়ের আলোচনা লিখে দিই। ২০০১ সালে আমি আমার সম্পাদিত ‘কচিহাত’ পত্রিকার জন্য এমরান ভাইয়ের একটি সাক্ষাৎকার নিই। সাক্ষাৎকারটি পরে ২০১৯ সালে আমার ‘ছয় গুণী ছড়াশিল্পী‘ গ্রন্থেও অন্তর্ভুক্ত করি। বইটি অপর পাঁচ জনের সঙ্গে এমরান ভাইকেও উৎসর্গ করি। এমরান ভাইও তাঁর সাত বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে রচিত বইটিও আমিসহ সাতজনকে উৎসর্গ করেন। শান্ত, শিষ্ট, ভদ্র, সদালাপী এমরান ভাই নিয়মিত ‘আলোর পাতা’ প্রকাশ করে বেশ সাড়া জাগিয়েছিলেন। শেষ সংখ্যাটির জন্য তিনি আমাদের ছড়াও চেয়েছিলেন। তার আগে একটি সংখ্যায় আমাদের দুজনের ছড়াই সযত্নে ছেপেছিলেন। ওই বিশেষ ছড়াসংখ্যাটি প্রজ্ঞালোক অফিস থেকে সংগ্রহ করতে গেলে কবি সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার ও কবি সৈয়দ জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে বেশ আড্ডা জমে ওঠে। আমরা সেদিন একফ্রেমে ছবিও তুলি। চট্টগ্রামের একজন নিবেদিতপ্রাণ শিশুসাহিত্যিক হিসেবে এমরান ভাই ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। বছর কয় আগে শিশুসাহিত্যে তিনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের একুশে সম্মাননা পদকও লাভ করেন। তাঁর অগ্রজ নাট্যজন, কবি অভীক ওসমান, অনুজা প্রকাশক রেহেনা চৌধুরীও আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন।
গত পাঁচ দিনে এমরান ভাইয়ের ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার সংবাদে বেশ কবার ছুটে ছুটে গেছি। ভয়ে ভয়ে কান পেতেছি ফোনে। ইনবক্সে, ম্যাসেঞ্জারে অস্থির সময় কাটিয়েছি। তাঁর আপন ভাইয়ের মত আমিও প্রাণভরে প্রার্থনা করেছি। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি এভাবে চলে যাবেন কখনো ভাবিনি। বাবু ভাই বলেছেন তাকে নিয়ে ছড়া লিখতে। কিন্তু আমার শোকাহত মন কিছুতেই বাঁধ মানছে না। আপ্রাণ ভুলে থাকার চেষ্টায় তাই এই লেখা। প্রতি শুক্রবার মায়ের কবর জেয়ারতে এখন থেকে সবার সাথে এ নামটিও বুক ভাঙা শোকে উচ্চারিত হবে।











