নিঃশব্দ ভোর যেমন ধীরে ধীরে আলোয় ভরে ওঠে, মানুষের অন্তর্গত প্রতিভাও তেমনই–চুপচাপ অপেক্ষায় থাকে সঠিক পরিবেশ, যত্ন আর দিকনির্দেশনার। মনজগতের তাড়িত ভাবনা সেই সত্যকে আরও গভীরভাবে সামনে আনে। মানুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি প্রতিভা আসলে সমাজের একেকটি সম্ভাবনার প্রদীপ, কিন্তু সেই প্রদীপ জ্বলে উঠতে না পারার কারণও কম নয়। কখনো পারিবারিক অবহেলা, কখনো অজ্ঞতা, কখনো ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা কিংবা কুসংস্কারের দহন–সব মিলিয়ে প্রতিভা বিকাশের পথ হয়ে ওঠে পাথুরে। সামান্য উৎসাহ, স্নেহ আর সঠিক পথনির্দেশ পেলে যে প্রতিভাগুলো সহজেই বিকশিত হতে পারত, তারা অনেক সময়ই অঙ্কুরে থেমে যায়।
সমাজে এমন অসংখ্য প্রতিভা ছিল যাদের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরি হয়নি। তাদের নাম আমরা জানি না, তাদের শক্তি আমরা দেখিনি, আর তাদের সম্ভাবনা ইতিহাসের কোনো পাতায় লেখা হয়নি। অথচ একটু যত্নশীল হলেই আমাদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির শাখাগুলো আরো শক্তিশালী, সমৃদ্ধ এবং দৃঢ় হয়ে উঠতে পারত। আজকের সংস্কৃতির অবস্থা দেখলে সেই ব্যর্থতার দায় আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অপসংস্কৃতির আগ্রাসন দিন দিন আমাদের নিজস্ব শিল্পভাবনা, বাঙালিয়ানার সৌন্দর্য, লোকজ ঐতিহ্যকে ক্ষয় করে দিচ্ছে। মানুষের নিজের সংস্কৃতির প্রতি অনাগ্রহ বাড়ছে; প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধীরে ধীরে দূরে সরে যাচ্ছে নিজের শেকড় থেকে।
একসময় যে বাংলা ছিল গান, ছন্দ, নৃত্য, নাটক, লোককথা, রূপকথা, প্রবাদের দেশ–আজকের শিশুদের কাছে সেই সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য অপরিচিত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কৃষ্টি কালচার ধীরে ধীরে সংকীর্ণ বলয়ে আবদ্ধ হয়ে পড়ছে। তারা এমন সব বিনোদনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে যার সঙ্গে নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের কোনো মিল নেই। অন্যদিকে বিদেশি অপসংস্কৃতির আকর্ষণীয় মোড়ক আমাদের শিশুদের কাছে আরো লোভনীয় হয়ে উঠছে। ফলে তারা ভুলে যাচ্ছে নিজেদের শিল্পের ঐতিহ্য, ভুলে যাচ্ছে বাঙালি জীবনের বিশেষ রং, ভুলে যাচ্ছে তাঁদের মাটির গন্ধ। এই ভুলে যাওয়ার পথই তাদের সিদ্ধান্তহীনতা আর দিকভ্রষ্টতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পরিবার হল সবচেয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেখানেই শিশুর সাংস্কৃতিক বোধ গড়ে ওঠে। পরিবারে যদি গান, নাটক, সাহিত্য, গল্প, ছবি আঁকা, আবৃত্তি এসবের পরিবেশ থাকে, তবে শিশুর মনোজগত অনেক বেশি সৃজনশীল হয়ে ওঠে। তারা নিজের প্রতিভাকে খুঁজে পেতে পারে, নিজের আগ্রহকে শক্তিশালী করতে পারে। কিন্তু পরিবারের অচর্চা, উদাসীনতা বা সাংস্কৃতিক দারিদ্র্য শিশুর মনকে বিস্তৃত করার বদলে সংকুচিত করে। এজন্য পরিবারে সংস্কৃতির সৎ চর্চা অপরিহার্য।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমকে গুরুত্বের সঙ্গে স্থান দিতে হবে। শুধু পাঠ্যবইয়ের ওপর নির্ভর করলে শিশুর মনের দরজা অর্ধেকই খোলা থাকে। স্কুলে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, গান, নাটক, নাচ, চিত্রাঙ্কন, রচনা প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি–এসব আয়োজন শিশুদের প্রতিভা বিকাশে বড় ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, গ্রামবাংলার জীবন, লোকসংস্কৃতি সম্পর্কে জানাতে শিক্ষা সফর, জাদুঘর ভ্রমণ, ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরতে যাওয়ার ব্যবস্থাও থাকা প্রয়োজন। শিশুরা বাস্তবের সঙ্গে পরিচিত হলে নিজের সংস্কৃতিকে আরও গভীরভাবে বুঝতে পারে।
পাঠাভ্যাসও এক ধরনের সাংস্কৃতিক শিক্ষা। শিশুরা যদি পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্প, কবিতা, জীবনী, উপন্যাস পড়তে শেখে, তবে তাদের ভাবনার জগৎ আরও বিস্তৃত হয়। বই মানুষের চিন্তা, মনন ও সিদ্ধান্তকে শাণিত করে। যে শিশু বই পড়ে, সে তার দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে অন্যের চেয়ে অনেক বেশি জানে। কিন্তু পাঠাভ্যাস কমে যাওয়ার ফলে নতুন প্রজন্মের মনোজগতেও একধরনের শূন্যতা তৈরি হচ্ছে।
বাংলার সংগীত আমাদের সংস্কৃতির অন্যতম শক্তি। পল্লীগীতি, ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, সারি, জারি, মুর্শিদি, মারফতি, লালনগীতি–এসব গান শুধু সুর নয়, এগুলো বাংলার ইতিহাস, মানুষের দুঃখসুখ, নদীর গ্রোত, মাঠের নিশ্বাস, গ্রামের সন্ধ্যার আলো। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এখনকার অনেক শিশুই এসব সম্পর্কে কিছু জানে না। তাদের কানে পৌঁছায় কেবল কৃত্রিম সুরের ঢেউ, অথচ নিজের সংস্কৃতির গভীর স্রোত তাদের অজানা থেকে যায়। চর্চার অভাব, প্রচারের ঘাটতি এবং পরিবার–সমাজের উদাসীনতার কারণে এই অমূল্য সম্পদ হারিয়ে যেতে বসেছে।
এখন সবচেয়ে জরুরি হলো–নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি সম্মান তৈরি করা, চর্চার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সন্তানদের হাতে আমাদের ঐতিহ্য তুলে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করা। প্রতিভা যেন অবহেলায় নষ্ট না হয়, শিশু যেন অপসংস্কৃতির ভিড়ে হারিয়ে না যায়, তারা যেন নিজের মাটির গন্ধ চিনতে পারে–এই লক্ষ্যেই পরিবার, সমাজ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বাংলার শিল্প–সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও বোধ আবারও শক্তভাবে দাঁড়াক, নতুন প্রজন্মের জীবনে আলো ছড়াক–এই প্রত্যাশাই আমাদের পথ দেখাক।
লেখক : কবি–চিত্রশিল্পী











