কক্সবাজারের টেকনাফের পাহাড় অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ এলাকায় অপহরণকারীদের দাপট কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে ভয়ংকর অপহরণকারী চক্র দাপট চালিয়ে যাচ্ছে। সংঘবদ্ধ ভয়ংকর সন্ত্রাসীদের সমন্বয়ে গঠিত একাধিক চক্র লাগাতার অপহরণ করে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করছে। আইন–শৃক্সখলাবাহিনী কোনোভাবেই এসব অপ্রতিরোধ্য চক্রের নাগাল পাচ্ছে না। এতে বর্তমানে ভয়, আতঙ্ক আর অনিশ্চয়তায় থমকে গেছে অন্তত অর্ধ লক্ষাধিক মানুষের জীবন।
স্থানীয়রা জানিয়েছেন, দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় ধরে সীমান্ত উপজেলা টেকনাফের পাহাড় অধ্যুষিত এলাকা টেকনাফ সদর, বাহারছড়া, হোয়াইক্যং ও হ্নীলার বিস্তীর্ণ এলাকায় দাপট চালাচ্ছে অন্তত ১২টি সংঘবদ্ধ অপহরণকারী চক্র। এসব চক্র এই সময়ে হাজারের অধিক মানুষকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করেছে। পরে প্রতিজন অপহৃতের পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের মুক্তিপণ আদায় করেছে। গত এক বছরে টেকনাফের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২৬৪ জন অপহৃত হয়েছে।
সর্বশেষ গত ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যায় বাহারছড়া ইউনিয়নের দক্ষিণ শিলখালী পূর্ব পাড়ায় পাহাড় থেকে নেমে আসা একদল সশস্ত্র অপহরণকারী ছয় শিশুকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। এদের মধ্যে দুজন কৌশলে পালিয়ে আসতে সক্ষম হলেও চারজন শিশু এখনও নিখোঁজ রয়েছে। নিখোঁজ চার শিশু হল স্থানীয় মো. মামুন (১৭), আনোয়ার হোসেন (১৪), গিয়াস উদ্দিন (১৫), আবু বক্কর ছিদ্দিক (১৩)। তাদের মুক্তি দিতে তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করছে বলে জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা। বাহারছড়া ইউনিয়নের ৪ নং ওয়ার্ড ইউপি সদস্য হাফেজ আহমদ বলেন, অপহরণকারীরা মোবাইলে কল দিয়ে প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে দুই থেকে তিন লাখ টাকা দাবি করছে।
এদিকে গত বুধবার বিকালে স্থানীয়রা টেকনাফ–মেরিন ড্রাইভ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন। তাদের দাবি, পাহাড়ে সক্রিয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান এবং দ্রুত উদ্ধার তৎপরতা জোরদার করা। স্থানীয়রা সব অপহরণের ঘটনায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ব্যবহার এবং অভিযান পরিচালনায় আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বয়হীনতাকে দায়ী করেন।
টেকনাফ হ্নীলার বাসিন্দা আবদুর রহিম বলেন, টেকনাফে অপহরণের মাত্রা সীমা ছাড়িয়ে গেছে। যার ফলে এলাকায় স্থানীয় মানুষ আতঙ্কিত। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বারবার অভিযান চালানো হলেও তা কোনো কাজে আসছে না। কেননা প্রশাসন অপহরণকারী সন্ত্রাসীদের নাগালই পায় না। বাহারছড়ার বাসিন্দা তারেকুর রহমান বলেন, এই অপহরণের পিছনে কিছু স্থানীয় সহযোগিতা করছে, যার ফলে অপহরণ নির্মূলের বিষয়টা আরও জটিল হয়ে উঠেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে–মানুষ ঘর থেকেই বের হতে ভয় পাচ্ছে। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে বড় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না।
বাহারছড়া শামলাপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনজুরুল ইসলাম বলেন, সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে প্রশাসনকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত। ধারাবাহিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে ব্লকেডসহ আমরা নানা কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছি। কিন্তু কোনো ফল পাচ্ছি না।
বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন বলেন, বাহারছড়া অপহরণের ‘হটজোন’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছে। এই ইউনিয়নে পাহাড়ি এলাকায় মানুষের বাস বেশি। এছাড়া মেরিনড্রাইভ সড়কে লাগোয়া দুর্গম পাহাড়ও রয়েছে। এসব কারণে অনায়সেই সন্ত্রাসীরা প্রতিনিয়ত নানাভাবে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়।
হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর আহমদ আনোয়ারী বলেন, আমার ইউনিয়ন থেকে শতাধিক মানুষ অপহৃত হয়েছেন। কমবেশি সবাই মুক্তিপণ দিয়ে বাড়ি ফিরেছেন। অপহরণ আতঙ্কে অনেকে চাষাবাদ ছেড়ে দিচ্ছেন।
টেকনাফ উপজেলা বিএনপির সভাপতি এড. হাসান ছিদ্দিকী বলেন, কতিপয় প্রভাবশালী ও ইয়াবা গডফাদারের ছত্রছায়ায় রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা অপহরণ বাণিজ্য শুরু করে। এখনো তা নিয়ন্ত্রণহীন। অপহরণকারী চক্রের তৎপরতা থামাতে সব বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ অভিযান দরকার।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি জায়েদ নূর বলেন, অপহরণ রোধ ও অপহরণকারীদের ধরতে বিভিন্ন সময় পুলিশ বহু অভিযান চালিয়েছে। এমনকি সব বাহিনীর যৌথ টাস্কফোর্সের মাধ্যমে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে অপরাধীরে আস্তানা ধ্বংস করা হয়েছে। কিন্তু গহীন পাহাড়ে পালিয়ে যাওয়া সন্ত্রাসীদের ধরা যায় না। আমরা নিয়মিত অভিযান ও নজরদারি জোরদার রেখেছি।









