সমৃদ্ধ দিনের গান

ইয়াসিন আরাফাত | শুক্রবার , ৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:৫৭ পূর্বাহ্ণ

আজ দেরি হয়ে গেল আর্চনার। ফ্যাক্টরিতে ঢুকতে দেয়নি। নতুন চাকরি, ঘর থেকে বেশ দূরে। আগের চাকরিতে ৪ মাসের বেতন বাকি ছিল, ওখানে একটু ঢুঁ মারতে গিয়ে দেরিটা হল। বেতনগুলো পাওয়ার আশা নেই। এখানে মাস শেষে কত টাকা কাটে কে জানে। পরাজিতের মতো মাথা নিচু করে বাড়ির পথ ধরেছে সে। মাথার ভেতর গিজগিজ করছে অসংখ্য অসংখ্য শব্দটাকা টাকাবাকি বাকিওভারটাইমচালের বস্তাপাওনাদারএসব ভাবতে ভাবতে তার ঘুম হয় না, বার বার মনে হয়যদি মরে যায় আমার মেয়েটার কি হবেবাপ থেকেও নেইকত দুপুর রাত ভাত তুলে দিতে পারেনি মুখেনিজে অভুক্ত থেকে ডিউটি করেছে দিনের পর দিনরাস্তায় সবার প্রশ্নকিরে আর্চনা, নাইট ছিল নাকিকি আর উত্তর দেবে তাদেরএঁদের অনেকের কাছেই সে হাত পেতেছিল, কেউ দিয়েছে কেউ দিতে পারেনিসকালবেলা চা খেয়ে বের হলে মাথা ভাল কাজ করত, বেশ বিলাসবহুল কথাবার্তা, তার হাসি পায়গত দু’মাস তার ঘরে চা হয়নিবাড়ির কাছাকাছি এলে চৌধুরী পুকুর পাড়ে পড়ে দূর্গা মন্দির, সব সময় এখানে প্রণাম করে যায় সে। আহা মৃন্ময়ী, কত পূজা করি তোরসাধ্যের দুফোঁটা করুণায়ই তো আমার হয়ে যেতদ’ুবেলা খেয়েপরে খেতে পেলে তোর পূজা আরো প্রাণভরে করব। না, দশ ভূজাও হাভাতের হাঁড়িতে সমৃদ্ধি দেয় না, তার নজর কেবল পূজোর থালায়। ঘরে ঢুকতেই মেয়ে ছুটেআসেকি রে মা, যাও নাই আইজ? ভাল হইছেআমরা আজ দুপুরে মহোৎসবে যাব। মেয়ের চোখ পেটপুরে খেতে পাবার লোভে চকচক করছে। যেভাবেই হোক, ঘরে ফেরাটা সবসময় আনন্দেরআর্চনার মা থাকে সাথে, তিনি গেছেন আড়তের সবজি কুড়াতে। সবজির খুব দাম, একটা পাতাও ফেলে না আর। কিছু বাঁধা কপির পাতা, কিছু অর্ধপঁচা আলু নিয়ে ফিরেছেন তিনিমেয়েকে দেখে অবাক, একটু হেসে বললভাল হইছে, ফিইরা আইছিস, আজ মহোৎসবে যামু। এ মুখ দেখলেইতো ক্লান্তি মুছে যায়। আর্চনার হঠাৎ কান্না আসে, প্রতিদিন যদি উৎসব জমিয়ে দিতে পারত এদের জন্য। সমৃদ্ধ দিনের আশায় আর্চনার এত এত প্রার্থনা কোন ভগবানের কাছে যায় কে জানে। কলতলায় গিয়ে হাত মুখে জল দিতে দিতে মেয়ের ডাক শুনলমা ঝুলন কাকা ডাকেএটা শুনেই আর্চনার কপালে ভাঁজ পড়ল। সে মুখটা আঁচলে মুছে হাজিরা দিতে গেল। ঝুলন মুদির দোকানদার, অনেক টাকা বাকি তার কাছে, সে না থাকলে না খেয়ে মরতে হতো। আর্চনাকে দেখে বললকি রে বেতন দেয়নি এখনো, বাকি তো বেশি হইয়া গেছেআর তো দোকানেও যাস নাঅন্য কোথাও বাকি নিচ্ছিস? আর্চনার কান্না এরপর আর বাঁধা মানল না, সে কাঁদতে কাঁদতে বলেকে দেবে আমারে বাকিদাদাউপোস করি দাদা, পুণ্য কামাই করছি দাদা। ঝুলনকে হাত ধরে রান্নাঘরে নিয়ে যায় আর্চনা, হাঁড়ি, ভাঁড়ার উল্টে উল্টে দেখায়, খাঁ খাঁ করছে সব। ঝুলন বেচারা হতভম্ব হয়ে যায় হাভাতে মানুষের বিলাপেসে ফিরে যায়, অন্য কোনো বাকির ঘরে। শিবরাত্রির নির্জলা উপোসেও আর্চনাদের ক্লান্তি লাগে না। মাসের পর মাস তাদের অক্লান্ত উপোস। তাদের পুণ্যের কলসি নিশ্চয়ই এত সমৃদ্ধ হচ্ছে যে ভগবানও ক্লান্ত হয়ে গেছে কলসি নিতে নিতে। হয়ত তার বদলে কথিত স্বর্গে জুটে যাবে নিয়ত উৎসবের প্রসাদ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅজ্ঞাতনামা
পরবর্তী নিবন্ধএআই-পাড়ার সাহিত্য