প্রিয় মুসলিম ভাইয়েরা! আল্লাহ তা’আলাকে ভয় করুন, জেনে রাখুন, মহান আল্লাহ মানব জাতিকে সৃষ্টির সেরা হিসেবে ষোষণা করেছিলেন। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জাতি মানুষ গুলো যখন আল্লাহর সাথে কৃত অঙ্গীকার ভুলে কুফর শির্ক ও মূর্তি পূজার মাধ্যমে সর্বনিকৃষ্ট জীবে পরিণত হয়েছিল। মূর্তির পদতলে লুটিয়ে পড়ে নাফরমানি ও গোমরাহির ভয়ংকর আঁধারে নিমজ্জিত হয়েছিল। বিশ্ব বিধাতা মহীয়ান স্রষ্টার মাহাত্ম্য ভুলে নিথর নিস্পৃহ দেবদেবীর দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে বর্বরতা ও অসভ্যতার চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছিল তখনি নবী–রাসূল আলাইহিমুস সালামদের ধরাধামে শুভাগমন প্রতিটি অমানিশাকে পূর্ণিমার আলোয় উজ্জ্বল করে তুলেছিল। নবী রাসূলগণের হেদায়ত ও দ্বীনি দাওয়াত, কুফর আর শিরকের দুর্গন্ধে অবরুদ্ধ মানবাত্মাকে ঈমানের আলোয় সুরভিত করে তুলেছিল। নবী রাসূল প্রেরণের ধারাবাহিকতায় আল কুরআনে উল্লিখিত নবীগণের মধ্যে হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম অন্যতম।
হযরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম এর পরিচিতি:
হযরত ইবরাহীম খলীলুল্লাহ (আ.) এর স্ত্রী হযরত হাজেরার গর্ভে প্রথম পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) জন্ম গ্রহণ করেন। হযরত ইসমাঈল (আ.) এর উপাধি “জবীহহুল্লাহ” তাঁর নাম ইসমাঈল। তিনি আনুমানিক খ্রি. পূর্ব ২০৭৪ সনে পবিত্র পূণ্যভূমি জেরুজালেমে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম হযরত ইবরাহীম, মাতার নাম হাজেরা। হযরত ইসমাইল (আ.) সম্পর্কে কুরআনে ৯টি সূরায় ২৫টি আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ইবরাহীম (আ.) এর জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং মা হাজেরার একমাত্র সন্তান। ঐ সময়ে ইবরাহীম (আ.) এর বয়স ছিল ৮৬ বছর। ( আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া, খ:১, পৃ: ১৭৯)
১৩ বছর বয়সে হযরত ইসমাঈল (আ.) এর খতনা হয়। কাবাগৃহ পুনর্নির্মাণের সময় ইবরাহীম (আ.)’র বয়স ছিল ১০৬ বছর। ইবরাহীম (আ.) ১৭৫ বছর জীবিত ছিলেন হযরত ইসমাঈল (আ.) ১৩৬ বছর হায়াত লাভ করেছিলেন। ঐতিহাসিকগণের মতে তিনি এবং তাঁর মাতা হাজেরা (আ.) কাবা শরীফের পাশেই সমাহিত রয়েছেন।
নামকরণ: ইসমাঈল (আ.) ইবরানি শব্দ, এর অর্থ হলো “ইয়াসমাউল্লাহু” আল্লাহ শোনেন, সাড়া দেন, যেহেতু ৮৬ বছর বয়সে ইবরাহীম (আ.) আল্লাহ তা’আলার কাছে সন্তান কামনা করে দুআ করেছিলেন সেই দুআয় সাড়া দিয়ে আল্লাহ তা’আলা ইসমাঈল আলাইহিস সালামকে দান করেছিলেন তাই–এ নামে নামকরণ করা হয়।
মক্কায় বসবাস ও খানায়ে ক্বাবা পুনর্নির্মাণ:
বিশ্ব মুসলামানদের ঈমান ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র মক্কায় অবস্থিত ক্বাবা শরীফের সাথে হযরত ইবরাহীম (আ.) ও তদীয় পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) এর পবিত্র স্মৃতি জড়িত। হযরত ইবরাহীম (আ.) তাঁকে ও তাঁর মা হাজেরাকে নিয়ে মক্কায় বসতি স্থাপন করেন। আল্লাহর নির্দেশক্রমে হযরত ইবরাহীম ও হযরত ইসমাঈল (আ.) হযরত আদম আলাইহিস সালাম এর যুগের ভিত্তির উপর খানায়ে ক্বাবা পুন:নির্মাণের কাজ শুরু করেন। এ ভাবে হযরত ইবরাহীম (আ.) পাথর ও মশালাদি দিয়ে তাঁকে নির্মাণ কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। নির্মাণ কাজ শেষে উভয়ে মহান আল্লাহর দরবারে এ ভাবে দুআ করেছিলেন, “ আর যখন ইবরাহীম এ ঘরের ভিত্তি দিচ্ছিলেন এবং ইসমাঈল ও প্রার্থনারত অবস্থায় হে আমাদের রব! আমাদের পক্ষ থেকে কবুল করুন। নিঃসন্দেহে আপনি সব কিছু শোনেন সব কিছু জানেন। (সূরা: বাক্বারা, আয়াত: ১২৭)
বর্ণিত আয়াতের ব্যাখ্যায় হাকীমুল উম্মত মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী (রহ.) প্রণীত “তাফসীর নুরুল ইরফানে” বর্ণিত, হয়েছে, সওয়াবের কাজ করে কবুল হবার জন্য দুআ করা হযরত ইবরাহীম খলীল আলাইহিস সালাম এর সুন্নাত। সুতরাং জানাযা নামায ও রোজার ইফতারের সময়ের দুআ সমূহ উত্তম। মসজিদ নির্মাণ শেষে উদ্বোধন কালে বুজুর্গ ব্যক্তির মাধ্যমে দুআ করা উত্তম হওয়ার পক্ষে এ আয়াতে করীমা উজ্বল প্রমাণ স্বরূপ। আরো প্রতীয়মান হলো যে, আল্লাহ তাঁর মকবুল বান্দাদের দুআ প্রার্থনা শোনেন ও কবুল করেন।
হযরত ইসমাঈল (আ.)’র বংশধর:
হযরত ইসমাঈল (আ.)’র বারো জন পুত্র ছিল। তাঁর সন্তানদের মধ্যে আল্লাহ তা’আলা অত্যাধিক বরকত দান করেছিলেন। সমগ্র আরবে তাঁর বংশ বিস্তার ঘটেছে, মিশর, ইয়েমেন, সিরিয়া পর্যন্ত তাঁর পরিধি বিস্তৃতি ছিল। হযরত ইসমাঈল (আ.) এর বংশ এতোই বৃদ্ধি পেয়েছিল যে, মক্কায় তাঁদের স্থান সংকুলান হলোনা, হিজাজের সর্বত্র তাঁরা ছড়িয়ে পড়লো, পবিত্র ক্বাবা গৃহের রক্ষণাবেক্ষণ ও মক্কা মুকাররমার কর্তৃত্ব সর্বদা এদেরই হাতে ন্যস্ত ছিল। হযরত ইসমাঈল (আ.)’র এক সন্তানের নাম ছিল ক্বাইদার। যিনি সমাজের সম্ভ্রান্ত ও সুপরিচিত সম্মানিত ছিলেন। তাঁর সন্তানরা মক্কায় বসবাস করতেন, আদর্শ পিতার অনুসরণে তাঁরাও ক্বাবা শরীফের খিদমত করতেন। ক্বাইদারের বংশধর হলেন আদনান, তিনিও অতীব মর্যাদাবান ব্যক্তিত্ব ছিলেন আদনানের বংশের মধ্যে কুসাই নামক এক সম্মানিত ব্যক্তির জন্ম হয়। কুসাইয়ের পর তদীয় পুত্র আবদে মানাফ। তদীয় পুত্র হাশিম, তদীয় পুত্র আবদুল মুত্তালিব। হযরত আবদুল মুত্তালিবের পুত্র হযরত আবদুল্লাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যাঁর নুরানী সন্তান হলেন তামাম জাহানের সরদার কামলিওয়ালা নবী রাহমাতুল্লীল আলামীন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। (সীরাতুল মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃত: শাইখুল হাদীস আল্লামা আবদুল মুস্তাফা আযমী (রহ.) পৃ: ৩০–৩১)
বনু আদনান ও হযরত ইসমাঈল (আ.) এর বংশধারা বাহির থেকে আরবে এসে বসতি স্থাপন করেন। এ জন্যই তাঁদেরকে আরবে মুসতাআরিবা বা মিশ্র আরব নামে আভিহিত করা হয়।
পবিত্র কুরআনের আলোকে হযরত ইসমাঈল (আ.)’র মর্যাদা:
হযরত ইসমাঈল (আ.) পবিত্র কুরআন উল্লিখিত নবী রাসূলগণের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আল্লাহ তা’আলা তাঁর সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, “এই কিতাবে আপনি ইসমাঈলের কথা বর্ণনা করুন। তিনি ছিলেন ওয়াদা রক্ষায় সত্যাশ্রয়ী এবং তিনি ছিলেন রাসূল ও নবী। তিনি তাঁর পরিবারবর্গকে সালাত ও যাকাত আদায়ের নির্দেশ দিতেন এবং তিনি স্বীয় পালনকর্তার নিকট পছন্দনীয় ছিলেন। (সূরা: মারইয়ম, আয়াত: ৫৪–৫৫)
ইতিহাসের বিস্ময়কর ত্যাগ ও কুরবানির ঘটনা:
হযরত ইবরাহীম (আ🙂 বড় বড় কঠিন অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছিলেন, প্রতিটি পরীক্ষায় আল্লাহ তাঁকে উত্তীর্ণ করেছেন। শিশু ইসমাঈল (আ.) ধীরে ধীরে কৈশোরে পদার্পন করলেন, ইবরাহীম (আ.) আল্লাহর পক্ষ থেকে স্বপ্নযোগে আদিষ্ট হলেন নিজ হাতে তাঁর প্রিয় সন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.) কে আল্লাহর নামে কুরবানি করতে। ইব্রাহীম (আ.) বুঝতে পারলেন এ স্বপ্ন ওহীরই অন্তর্ভুক্ত। যা অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য। তিনি কোন প্রকার দ্বিধা সংশয় না করে পুত্রকে স্বপ্নের কথা ব্যক্ত করলেন পুত্রের মতামত জানতে চাইলেন। ধৈর্য ও আনুগত্যের এক উজ্জ্বলতম অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন, হযরত ইসমাইল (আ.) যেমন পিতা তেমন পুত্র। অনুগত স্নেহাস্পদ পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) বিনম্র শ্রদ্ধায় উত্তর দিলেন, “হে পিতা! আপনি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছেন তা নির্দ্বিধায় পালন করুন, আপনি ইনশাআল্লাহ আমাকে ধৈর্যশীলদের অর্ন্তভূক্ত পাবেন। পিতা নিজের সন্তানকে জবাই করার জন্য গর্দানে ছুরি চালাতে উদ্যক্ত হলেন। ইসমাঈল (আ.) কে জবেহ করানো আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিলনা। আল্লাহর প্রেমে নিজের প্রিয়তম বস্তু উৎসর্গ করার মানসিকতা পরীক্ষা করাটা ছিল আল্লাহর উদ্দেশ্য। পিতা পুত্র দুজনেই প্রেমের পরীক্ষায় শতভাগ উত্তীর্ণ হলেন। মহিমান্বিত করুণাময় দয়ালু আল্লাহ তা’আলা ইবরাহীম (আ.)কে ছেলের গর্দানে ছুরি চালানোর কঠিন মুহূর্তে একটি বেহেস্তী দুম্বার সাহায্যে ইসমাঈল (আ.) কে মুক্ত করে নিলেন। এ কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ও মহা সাফল্য অর্জনের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহ তাঁকে গোটা মানব জাতির ইমামতের দায়িত্ব আর্পন করে তাঁকে সম্মানিত ও ধন্য করেছেন। তাঁরা উভয়েই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। মিল্লাতে ইবরাহীম স্মৃতির নিদর্শন হিসেবে পশু কুরবানি করার বিধান চালু হয়ে গেল, এর মাধ্যমেই হযরত ইসমাঈল (আ.) “জবীহুল্লাহ” আল্লাহর পথে (উৎসর্গকৃত) উপাধিতে ভূষিত হলেন।
হযরত ইসমাঈল (আ.)’র বংশ থেকে নূর নবীজি নির্বাচিত:
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর পবিত্র বংশধারা সম্পর্কে এরশাদ করেছেন, “নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা ইসমাইলের বংশ থেকে কিনানাহকে বাছাই করেছেন, কিনানার বংশ থেকে কুরাইশকে বাচাই করেছেন, এরপর কুরাইশদের থেকে নির্বাচিত করেছেন বুন হাশেমকে আর বনু হাশেম থেকে নির্বাচিত করেছেন আমাকে। (সহীহ মুসলিম, হাদীস: ৪৩৪১), হে আল্লাহ! আমাদেরকে নবী রাসূল আলাইহিমুস সালাম এর দ্বীনি দাওয়াত ও আদর্শ অনুসরণ করার তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : অধ্যক্ষ, মাদরাসা–এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।











