দুদক হোক অপরাধীদের আতংকের নাম

এম.এ. মাসুদ | সোমবার , ১ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৫:০৪ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশে যে আর্থিকভাবে সচ্ছল একটি নতুন শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছে তা সাধারণ বোধ বুদ্ধি সম্পন্ন যে কোনও মানুষই বুঝতে পারেন। শুধু শহরে নয়, সারা দেশের উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে এই শ্রেণির মানুষের জীবন যাপনের চিত্র চোখে পড়ে। আর্থিকভাবে সচ্ছল ও স্বনির্ভর এই নতুন শ্রেণিটি কিন্তু অবৈধ পথের ধনী নয়। তাদের আর্থিক সচ্ছলতার পিছনে রয়েছে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের নিরলস প্রচেষ্টা। বিগত দিনের নিজেদের অসচ্ছল আর্থিক অবস্থার বিষয়টি স্মরণে থাকায় এই শ্রেণিটি তাদের দৈনন্দিন জীবানাচারে নিজেদেরকে যথাসম্ভব সংযত এবং পরিমিতির মধ্যে রাখেন। এই শ্রেণির সমান্তরালে দেশে আর একটি নতুন সম্পদশালী সম্প্রদায়ের উত্থান ঘটেছে। তাদের উত্থান ঋণখেলাপী, বেআইনী, অনৈতিক ও ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া পথে। অতি অল্প সময়ে এরা এত বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন যে, যা অত্যন্ত বিষ্ময়কর। আলাদিনের চেরাগ ঘষেও এত সম্পদঅর্থের মালিক হওয়া যাবে না। ২০২০২০২১ সালে করোনা কালে যেখানে মানুষের জীবনের প্রশ্ন জড়িত ছিল। সেখানে স্বাস্থ্য প্রশাসনের মদদে কতিপয় ব্যক্তি ভুয়া ডায়াগনস্টিক সেন্টার খুলে করোনায় আতংকগ্রস্ত মানুষকে করোনা পরীক্ষার নামে জালিয়াতি করে ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। এসকল মানুষরূপী জানোয়ারদের মধ্যে দু’একজন ধরা পড়েছে, কিন্তু বেশির ভাগই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে। ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য সরকারের মহতি উদ্যোগ ‘আশ্রয়ন’ প্রকল্পের টাকা যারা চুরি করেছে তারা এবং করোনার ভুয়া রিপোর্ট প্রদানকারী ভুয়া ডায়গনস্টিক সেন্টারের সাথে সংশ্লিষ্টরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় লালিত।

অবিশ্বাস্য দ্রুততম সময়ে অঢেল অর্থ সম্পদের অধিকারী হয়ে ফুলেফেঁপে ওঠা এই শ্রেণির ব্যক্তিরা তাদের জৌলুসপূর্ণ বিলাসী জীবনাচার, ঔদ্ধত্য ও অহমিকাপূর্ণ আচরণের কারণে মানুষের কাছে সহজেই চিহ্নিত হয়ে যান। শর্টকাট পথে সম্পদের মালিক হওয়া এই শ্রেণির মধ্যে কেউ কেউ সামাজিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে জড়িত হয়ে জনদরদী হওয়ার প্রয়াসী হন। অবৈধ পথে সম্পদ ও অর্থকড়ি অর্জনকারীদের ধরে আইনের আওতায় আনার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন নামে যে প্রতিষ্ঠান আছে, এর কতিপয় কর্মকর্তাকর্মচারীর বিষয়ে জনমনে প্রশ্ন জেগেছে। এই প্রশ্ন জাগার কারণ হল, দুর্নীতি যারা করেন তাদের ধরার জন্য এই প্রতিষ্ঠানে যারা নিয়োজিত তাদের মধ্যে কিছু কিছু কর্মকর্তাকর্মচারীর সাথে দুর্নীতিবাজদের সখ্যতা। ব্যাংক জালিয়াতদের রক্ষার জন্য নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহা আলমকে বলির পাঁঠা বানিয়ে ব্যাংক লুণ্ঠন মামলায় ফাঁসানো এবং দুদক কর্মকতা এনামুল বাছির কর্তৃক একজন অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে মোটা অংকের আর্থিক সুবিধা নিয়ে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ে জেলে যাওয়ার উদাহরণতো সবার জানা। ব্যাংকের টাকা লোপাট না করেও দীর্ঘদিন জেলখাটা জাহা আলমকে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কিনা তা দেশবাসী জানে না। দুর্নীতিবাজ দুদক কর্মকর্তা ও পুলিশ অফিসারের কি সাজা হল তাও সবার অজানা। হয়তো বা এরা জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে এসে লুণ্ঠিত অর্থে ধোয়া তুলসী পাতা সেজে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন। আর পাটকল শ্রমিক জাহা আলম হয়তো তার কায়িক শ্রমের পেশায় ফিরে গেছেন। তার জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া দীর্ঘ কয়েকটি বছর ফিরিয়ে দেওয়া বা তার ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা সবাই বিস্মৃত হয়ে গেছেন। এ কারণে সর্ষের ভিতর ঘাপটি মেরে থাকা ভূত পাকড়াও করার জন্য উপায় উদ্ভাবন এবং অব্যর্থ মহৌষধের প্রয়োগ অতি জরুরী হয়ে পড়েছে। অন্যথায় দুর্নীতি দমনের মত অত্যন্ত জনগুরুত্ব সম্পন্ন কাজে নিয়োজিত এই প্রতিষ্ঠানের উপর জনগণের আস্থা থাকবে না।

শেয়ার বাজার লুট করে যারা শূন্য থেকে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের এই লুণ্ঠনঅর্জিত অর্থের প্রকৃত মালিক এদেশের নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণি। এসব মানুষ, যারা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন, তাদের পথে বসিয়ে কিছু দুর্বৃত্ত বিলাসী জীবন যাপন করছে। শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করা অর্থ হারিয়ে এই শ্রেণির মধ্যে আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটেছে। সর্বসান্ত হওয়া এ সকল মানুষের জীবন যন্ত্রণা, তাদের অন্তরের গহীন থেকে নির্গত মর্মবেদনা আর অভিশাপের দীর্ঘশ্বাস শেয়ার বাজার লুটেরাদের একটুও বিচলিত করে না। শেয়ার বাজার লুট করে আখের গোছানো এই নব্য ধনীদের নাম পরিচয় সবারই জানা। ঋণ নেওয়ার ছদ্মাবরণের অন্তরালে যারা ব্যাংক ঝাঁঝরা করেছেন, সোনালী ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, ফারমার্স ব্যাংক ও পাঁচটি ইসলামী ব্যাংক লুণ্ঠন করেছেন এবং হলমার্কডেসটিনি কেলেংকারীর সাথে যারা জড়িত, তাদের সবাই চেনেন। এতসব অপকর্ম করেও তারা অধরাই থেকে গেলেন।

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব পরবর্তীতে দেশের জনগণের প্রত্যাশা এই যে, দুদক এবং এ জাতীয় অন্যান্য সরকারি সংস্থা চুড়ান্ত সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করে যাবে। ব্যাংক লুণ্ঠনকারী ও সরকারি অর্থ লোপাটকারী, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত সাধুবেশী ডাকাতদের আইনের আওতায় আনার জন্য দুদকসহ এ সকল সংস্থা নির্মমভাবে সাঁড়াশি অভিযান অব্যাহত রাখবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা জুলাই বিপ্লব পরবর্তী পুনর্গঠিত দুদক কঠোর অবস্থানে থেকে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে অনুপম দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এবং এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দুদক দেশবাসীর কাছে তাদের গর্বের ও অনন্য গৌরবের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবে। মানুষ আশাবাদী হতে চায় যে, দুদকের তৎপরতার মাধ্যমে দেশে দুর্নীতির পরিমাণ অনেক কমে আসবে। যত বড় অর্থবিত্তের মালিকই হোক না কেন বা যত রাজনৈতিক প্রতাপশালী ব্যক্তিই হোক না কেন, দুদক তার দায়িত্ব পালনে পিছপা হবে না এবং এসব দুর্নীতিবাজদের অকুতোভয়ে পাকড়াও করে আইনের কাছে সোপর্দ করবে। সরকার এ কাজে সার্বক্ষণিকভাবে দুদকের সহায়ক হিসাবে কাজ করবে। দেশের মানুষের চাওয়া, দুদক যথাযথ ভাবে দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে দেশবাসীর সম্ভ্রম আদায় করে নেবে। দেশবাসীর প্রত্যাশা, দুদক গড়ে উঠবে সিবিআই বা এফবিআইয়ের মত অপরাধ বিজ্ঞানে পারাঙ্গম এবং অপরাধী ধরার বিষয়ে হবে চৌকষ। দুদক হবে বাংলাদেশের অহংকার এবং অপরাধীদের জন্য হবে আতংক।

লেখক : বর্ষীয়ান নাগরিক ও সমাজকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএস টি কোলরিজের কবিতায় অতিপ্রাকৃতবাদ
পরবর্তী নিবন্ধএমপি সিরাজ : কীর্তির মাঝেই যিনি এখনো অক্ষয়