অবৈধ সিগারেটে সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব, বাড়ছে জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি

আরাফাত ইসলাম | রবিবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২৫ at ১১:২২ পূর্বাহ্ণ

দেশে অবৈধ সিগারেটের সিন্ডিকেট বাড়ায় সরকার যেমন হারাচ্ছে রাজস্ব; অন্যদিকে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে সাধারণ জনগণ। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছে, দেশের অনুমোদিত সিগারেট কোম্পানির চেয়ে অবৈধ নকল সিগারেট স্বাস্থ্যের জন্য বেশি ক্ষতিকর।

সমপ্রতি সরজমিনে চট্টগ্রামের আনোয়ারা ও রাউজান উপজেলার বিভিন্ন বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বাজারের প্রত্যেকটি দোকানে প্রকাশ্যেই অবৈধ এবং স্থানীয়ভাবে তৈরি নকল সিগারেট প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। দোকানের তাকজুড়ে সাজানো রয়েছে টি২০, মার্বেল, পুরবি, এক্সপ্রেস, মার্বেল ও ওসাকা সিগারেট। এসব সিগারেট প্রতি প্যাকেট মাত্র ৪৫ থেকে ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, যা সরকারনির্ধারিত ন্যূনতম খুচরা মূল্যের চেয়ে অনেক কম।

দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব সিগারেটের প্রতিটি খালি প্যাকেট ফেরত দিলে পাওয়া যায় ৫ টাকা করে ক্যাশব্যাক। এই কৌশলের কারণে খুচরা বিক্রেতাদের মধ্যে সেগুলোর চাহিদা দ্রুত বাড়ছে।

রাজস্ব ক্ষতি বাড়ছে প্রতি বছরে :

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্র জানায়, ২০২৪২৫ অর্থবছরে সিগারেট ও তামাক খাত থেকে রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে কর হার বাড়ানো হয়েছিল। কিন্তু উচ্চ করের কারণে বৈধ সিগারেটের দাম বেড়ে যাওয়ায় ক্রেতারা এখন ঝুঁকছেন সস্তা অবৈধ ব্র্যান্ডের দিকে। এতে বৈধ বাজার সংকুচিত হচ্ছে, রাজস্ব আয়ও কমছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে সমপ্রতি ধরা পড়ে ১৩৭ কোটি টাকার শুল্ক ফাঁকির চেষ্টা। ‘কাগজের চালান’ দেখিয়ে আনা হয়েছিল আসলে সিগারেট পেপার। এছাড়া গত কয়েক মাসে ১.২৫ কোটি স্টিক বিদেশি সিগারেট উদ্ধার হয়েছে যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ কোটি টাকা।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজের ডেপুটি কমিশনার এইচ এম কবির বলেন, ভেজালমুক্ত ও রাজস্ব সুরক্ষিত করতে কাস্টমস বিভাগ সব সময় জিরো টলারেন্স নীতি অনুসরণ করে। এরই অংশ হিসেবে আমাদের কাস্টম এলাকাতে গোয়েন্দা অভিযান চলে নিয়মিত। সমপ্রতিও কাগজ দেখিয়ে কর ফাঁকি দিতে আমদানি করা হয় সিগারেটের পেপার, আনার সময় আমদানিকারকে আটক করা হয়। পরে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এভাবেই যারা নকলপণ্য আমদানি কিংবা কাস্টমস কর ফাঁকি দিতে চায় তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করে যাচ্ছি।

অবৈধ ব্যবসার রুট ও পদ্ধতি :

তদন্তে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম বন্দর হয়ে কসমেটিকস, প্লাস্টিক দ্রব্য, ফার্নিচার এমনকি কমলালেবুর ঘোষণার আড়ালে আমদানি করা হয় কোটি কোটি টাকার সিগারেট। পাশাপাশি মহেশখালী, আনোয়ারা, রাউজান ও নগরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠেছে নকল সিগারেট কারখানা।

চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, লালখান বাজার ও চকবাজারে নকল ও বিদেশি সিগারেটের পাইকারি বিক্রি চলে প্রকাশ্যে। এখান থেকে এসব সিগারেট ছড়িয়ে পড়ে পুরো নগর ও উপজেলা শহরের পাশাপাশি সারা বাংলাদেশে। দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও সীমান্তবর্তী অবস্থানের সুযোগ নিয়ে অসাধু ব্যবসায়ীরা এখানে গড়ে তুলেছে অবৈধ আমদানি, পাচার ও নকল সিগারেট তৈরির বড় নেটওয়ার্ক বলে ধারণা করেছেন স্থানীয়রা। চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট এলাকার শাহাবুদ্দিন নামের এক দোকানদার বলেন, “এসব সিগারেট বিক্রি করলে লাভ বেশি হয়, আর দাম কম থাকায় ক্রেতারাও এসব বেশি নেয়। প্রতি পিস ১০ টাকা দরে বিক্রি করি। আবার প্যাকেট ফেরত দিলে অনেক কোম্পানি ৫ টাকা ফেরত দেয়।”

বন্দর, বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরের দুর্বল নজরদারির সুযোগ নিচ্ছে এই সিন্ডিকেট। কন্টেইনার স্ক্যানার পুরনো ও ধীরগতি ও লোকবল কম থাকায় প্রতিটি চালান পরীক্ষা সম্ভব হয় না। ফলে ভুয়া ঘোষণার আড়ালে সিগারেট ঢুকে যাচ্ছে সহজেই।

চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের বন্দর বিভাগের গোয়েন্দা শাখার ডিসি মোহাম্মদ আবু বক্কর সিদ্দিক বলেন, শুধু নকল সিগারেটই নয়, সকল ভেজাল পণ্যের বিরুদ্ধে সরকারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এসব অভিযানে ভেজালকারীদের গ্রেপ্তার করা হয় এবং আইনের আওতায় আনা হচ্ছে।

স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক ক্ষতি

অবৈধ সিগারেট শুধু রাজস্ব ঘাটতিই নয়, জনস্বাস্থ্যের জন্যও বড় হুমকি। এসব সিগারেট মান নিয়ন্ত্রণহীনভাবে তৈরি হওয়ায় এতে ক্ষতিকর উপাদান ও নকল কেমিক্যাল ব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সস্তার প্রলোভনে এসব সিগারেট ব্যবহার বাড়ছে তরুণদের মধ্যে, যা দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় স্বাস্থ্য খাতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করবে।

একজন শিল্পখাত বিশেষজ্ঞ বলেন, “অবৈধ সিগারেটের বিস্তার শুধু প্রশাসনিক ব্যর্থতা নয়, এটি অর্থনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতারও প্রতিফলন। কর কাঠামোকে ভারসাম্যপূর্ণ না করলে এবং বাজারে বৈধ বিকল্প ব্যবহার নিশ্চিত না করলে এই প্রবণতা বন্ধ হবে না।”

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণ সিগারেটের চেয়ে অবৈধ ও নকল সিগারেট বেশি ক্ষতিকর। সরকারি লাইসেন্স প্রাপ্ত সিগারেট কোম্পানি গুলো সে নিয়ম মানে সাধারণ সিগারেটের কোম্পানিগুলো সেই নিয়ম মানে না। তামাকের কারণে ফুসফুসের ক্যানসার, মুখমণ্ডলের ক্যানসার, বন্ধ্যাত্ব, হার্ট ডিজিজ, ব্রেইন স্ট্রোক, কোষ্ঠকাঠিন্য ইত্যাদির ঝুঁকি বহুগুণে বেড়ে যায়। এরসঙ্গে অবৈধ সুগন্ধি জাতীয় বা নকল সিগারেটে ব্যবহৃত ফলে মুখগহ্বর ও ফুসফুসের অ্যালার্জি, ফুসফুসের ক্যানসারের ঝুঁকিও বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসন্দেহভাজন একজন পুলিশ হেফাজতে
পরবর্তী নিবন্ধখালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বিভিন্নস্থানে দোয়া মাহফিল