হাসিনার ২১ বছর, জয় ও পুতুলের ৫ বছর করে কারাদণ্ড

প্লট দুর্নীতির তিন মামলা মোট ২৩ আসামির মধ্যে খালাস পেয়েছেন একজন, অন্যদের যে সাজা হলো

| শুক্রবার , ২৮ নভেম্বর, ২০২৫ at ৯:১১ পূর্বাহ্ণ

জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্লট দুর্নীতির তিন মামলায় ৭ বছর করে মোট ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। শেখ হাসিনার পাশাপাশি তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়কে একটি মামলায় এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলকে আরেক মামলায় পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ঢাকা শহরে বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা আবাসন সুবিধা থাকার পরেও সেই তথ্য গোপন করে তারা আইন ভেঙে দুর্নীতির মাধ্যমে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা আকারের তিনটি প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন। ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন গতকাল বৃহস্পতিবার ওই তিন মামলার রায় ঘোষণা করেন।

হাসিনা পরিবারের তিনজন ছাড়াও এ তিন মামলায় আরো ২০ জন আসামি ছিলেন, তাদের মধ্যে কেবল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার খালাস পেয়েছেন। বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়েছে। আসামিদের মধ্যে কেবল রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলম আত্মসমর্পণ করে কারাগারে ছিলেন। রায় ঘোষণার সময় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। আদালতকে সম্মান দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করায় তাকে লঘু শাস্তি হিসেবে এক বছর করে তিন মামলায় ৩ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। কারাদণ্ডের পাশাপাশি শেখ হাসিনাকে এক লাখ টাকা করে তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে তাকে ৬ মাস করে ১৮ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড; পুতুল ও জয়কে দণ্ডের পাশাপাশি এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে ৬ মাস করে বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। খবর বিডিনিউজের।

শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে তিন মামলায় দুদকের পক্ষে শুনানি করেন খান মো. মাইনুল হাসান লিপন। রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সাজা (যাবজ্জীবন) প্রত্যাশা করেছিলাম, তা হয়নি। কমিশনের সাথে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। অন্যদিকে গ্রেপ্তার একমাত্র আসামি খুরশীদ আলমের আইনজীবী ছিলেন শাহীনুর রহমান। রায়ের পর তিনি কোনো মন্তব্য করতে চাননি।

গত বছরের ৫ আগস্ট ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ আমলের অনিয়মদুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের মাধ্যমে রাজউকের পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ৬০ কাঠার প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে গত জানুয়ারিতে ছয়টি মামলা করে দুদক। এসব মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, বোন শেখ রেহানা, ভাগ্নি ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক, আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী ও ভাগ্নে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিকে আসামি করা হয়। হাসিনাকে আসামি করা হয় ছয় মামলাতেই। তার পরিবারের তিনটি মামলার বিচার চলে একসঙ্গে; আলাদা আদালতে রেহানা পরিবারের তিন মামলার বিচার একসঙ্গে চলে।

গত ৩১ জুলাই এসব মামলায় হাসিনা ও রেহেনা পরিবারের সাত সদস্যসহ ২৯ জনের বিরুদ্ধে (বেশিরভাগই একাধিক মামলায় অভিযুক্ত) অভিযোগ গঠন করে আদালত। চার মাসের মাথায় গত ২৩ নভেম্বর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে হাসিনা পরিবারের মামলার রায়ের দিন ঠিক করা হয়। আর ২৫ নভেম্বর রেহানার পরিবারের এক মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শেষে ১ ডিসেম্বর রায়ের দিন রেখেছে আদালত।

২৬ ডিসেম্বর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের পাঁচ সদস্যের নামে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। পূর্বাচলের ২৭ নম্বর সেক্টরের কূটনৈতিক জোনের ২০৩ নম্বর সড়কের আশপাশের এলাকায় শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, ছোট বোন শেখ রেহানা এবং তার ছেলেমেয়ে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও আজমিনা সিদ্দিকের নামে প্লটগুলো বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

শেখ হাসিনা ১০ কাঠার প্লট (প্লট নম্বর ৯) বরাদ্দ পেয়েছেন। ২০২২ সালের ৩ আগস্ট তার নামে রাজউক প্লটের বরাদ্দপত্র দেয়। সজীব ওয়াজেদ জয় (প্লট নম্বর ১৫) এবং মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলও (প্লট নম্বর ১৭) ১০ কাঠা করে প্লট পেয়েছেন। জয়ের বরাদ্দপত্র ২০২২ সালের ২৪ অক্টোবর দেওয়া হয় এবং ১০ নভেম্বর মালিকানা সংক্রান্ত রেজিস্ট্রি সম্পন্ন হয়। পুতুলের বরাদ্দপত্র দেওয়া হয় ওই বছরের ২ নভেম্বর।

শেখ রেহানাও ১০ কাঠার প্লট (প্লট নম্বর ১৩) বরাদ্দ পেয়েছেন। তার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববির (প্লট নম্বর ১১) এবং মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর (প্লট নম্বর ১৯) নামেও একই পরিমাণের প্লট বরাদ্দ হয়েছে।

তার আগে অক্টোবর মাসে শেখ হাসিনার পরিবারের ছয় সদস্যের নামে পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দে অনিয়ম নিয়ে সংবাদমাধ্যমে আসা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করে দেয় হাই কোর্ট। একইসঙ্গে এ কমিটিকে আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৫ বছরে (২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে) রাজউকের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগও তদন্ত করতে বলা হয়।

১৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনাসহ ৮ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন দুদকের উপ পরিচালক সালাহউদ্দিন। তদন্তে পাওয়া আরো চারজনসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে ১০ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া। আর পুতুলের প্লট বরাদ্দে অনিয়মের অভিযোগে তিনি ও তার মা শেখ হাসিনাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে ১২ জানুয়ারি মামলা করেন দুদকের সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া।

অন্যদের যে সাজা হলো : ঢাকার পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে প্লট দুর্নীতির দায়ে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের সঙ্গে আরও ১৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। আর অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় খালাস পেয়েছেন কেবল গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার।

প্লট দুর্নীতির ২ মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব মোহাম্মদ সালাহ উদ্দিনকে ৬ বছর করে মোট ১২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এক লাখ টাকা করে মোট ২ লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে দেওয়া হয়েছে ছয় মাস করে এক বছরের কারাদণ্ড।

সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদকে তিন মামলায় ৬ বছর করে মোট ১৮ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এক লাখ টাকা করে মোট তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও ৬ মাস করে দেড় বছরের কারাভোগ করতে হবে তাকে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার ও কাজী ওয়াছি উদ্দিনকেও একই সাজা ভোগ করতে হবে।

গৃহায়ন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদারকে তিন মামলায় এক বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। পাঁচ, দশ ও পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস করে তিন মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে।

রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞাকে তিন মামলায় দেওয়া হয়েছে পাঁচ বছর করে মোট ১৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পঞ্চাশ হাজার টাকা করে মোট দেড় লাখ টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও তিন মাস করে ৯ মাসের কারাদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সাবেক সদস্য (পরিকল্পনা) মোহাম্মদ নাসির উদ্দীনকে তিন মামলায় ৩ বছর করে মোট ৯ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা করে মোট ৬০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস করে ছয় মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের আরেক সাবেক সদস্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর প্রকৌশলী সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরীকেও একই সাজা দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সাবেক সদস্য (উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ) শফি উল হককে এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। সংস্থার আরেক সাবেক সদস্য (প্রশাসন ও অর্থ) কবির আল আসাদকেও একই সাজা দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সাবেক সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাসকে দুই মামলায় ৩ বছর করে মোট ৬ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা করে মোট ৪০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস করে চার মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) নুরুল ইসলামকেও দুই মামলায় একই সাজা দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) শেখ শাহিনুল ইসলামকে এক মামলায় তিন বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ২০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও দুই মাস কারাভোগের সাজা দেওয়া হয়েছে তাকে। রাজউকের পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) কামরুল ইসলামকেও এক মামলায় একই সাজা দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) হাফিজুর রহমান এক মামলায় পেয়েছেন এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস কারাভোগ করতে হবে তাকে। রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) হাবিবুর রহমান সবুজ ও মাজহারুল ইসলামকেও এক মামলায় একই সাজা দেওয়া হয়েছে।

রাজউকের সহকারী পরিচালক (এস্টেট ও ভূমি) নায়েব আলী শরীফ দুই মামলায় পেয়েছেন ১ বছর করে মোট ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড। পাঁচ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস করে ২ মাসের কারাভোগ করতে হবে তাকে।

রাজউকের সাবেক সদস্য (এস্টেট ও ভূমি) মোহাম্মদ খুরশীদ আলমকে তিন মামলায় ১ বছর করে মোট ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। ৫ হাজার টাকা করে মোট ১৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অনাদায়ে আরও এক মাস করে কারাভোগ করতে হবে তিন মাস। আসামিদের মধ্যে একমাত্র আসামি খুরশীদ আলম কারাগারে রয়েছেন। রায় ঘোষণার সময় তাকে আদালতে হাজির করা হয়। রায় শেষে সাজা পরোয়ানা দিয়ে তাকে আবার কারাগারে পাঠানো হয়। আদালতকে সম্মান দেখিয়ে আত্মসমর্পণ করায় তাকে লঘু শাস্তি দেওয়ার কথা জানিয়েছেন বিচারক। অপর আসামিরা পলাতক থাকায় আদালত তাদের বিরুদ্ধে সাজা পরোয়ানাসহ গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে আদালত।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅন্য একাধিক প্লটধারীদের খুঁজতে বলল আদালত
পরবর্তী নিবন্ধভাঙা হচ্ছে ৮১ বছরের প্রাচীন রাউজান-রাঙ্গুনিয়া পাবলিক হল