বাংলাদেশ আজ দ্রুত বড় হওয়া অর্থনীতি হিসেবে প্রশংসিত হলেও তার কাজের বাজারে বেকারত্ব একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিরাজমান রয়েছে। বাংলাদেশে ২০২৪ সালে বিদ্যমান শ্রমশক্তির মধ্যে আনুমানিক ৪.৭ % বেকারত্ব দেখা গেছে। এই মাত্রা যদি অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে তুলনা করি, তবে যদিও হার অনেক বেশি নয় বলে মনে করা হতে পারে, কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশের অর্থনৈতিক ও জনসংখ্যাগত প্রেক্ষাপটে এটি যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয়। বিশেষ করে যুবা ও নারী–শ্রমিকদের ক্ষেত্রে বেকারত্ব ও অলস কর্মসংস্থান – দুইই বড় সমস্যা হয়ে উঠেছে।
দেশে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ২০২৪ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকে বেকারত্ব হার ছিল প্রায় ৪.৪৯ % যেটি এক বছরের মধ্যে বেড়েছে। একই সময়কালে মহিলাদের বেকারত্ব হার ৭.১৬ %
২০২৪ সালের অক্টোবর–ডিসেম্বর ত্রৈমাসিকে বেকারত্ব হার ৪.৬৩ % হয়েছে। দেশে প্রতি বছরে প্রায় দুই মিলিয়নেরও বেশি যুব থেকে কাজের বাজারে প্রবেশ করছে, তবে প্রবেশের সংখ্যা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি–হারের মধ্যে ব্যবধান রয়েছে।
এই তথ্য থেকে পরিষ্কার যে, শুধু হার নয়, সংখ্যাগতভাবে কর্মসংস্থান সৃষ্টির চাহিদা রয়েছে। সুতরাং বেকারত্ব শুধুই শতাংশের বিষয় নয়, কর্মসংস্থানের সুযোগের ঘাটতির বিষয়ও। কোন ক্ষেত্রগুলো বেশি সমস্যায় রয়েছে?
নারীর বেকারত্ব হারের দ্রুত উত্থান দেখায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য আরও প্রকট।
তরুণদের ক্ষেত্রে কাজের বাজারে প্রবেশ ও দক্ষতা–সাপেক্ষ চাকরির ঘাটতি রয়েছে। আনুষ্ঠানিক ও অ–নানুষ্ঠানিক অর্থনীতির মধ্যে কর্মসংস্থানের অস্থিরতা রয়েছে, বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে কর্মস্থলে নিয়োগ ও নিরাপত্তা–শর্ত কম।
উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে কিছু কাজে চাহিদা কমে যাচ্ছে বা নতুন ধরনের কাজের জন্য দ্রুত প্রস্তুতি প্রয়োজন হয়ে পড়ছে।
দীর্ঘ সময় বেকার থাকা ব্যক্তি ও পরিবার মানসিক ও অর্থনৈতিক চাপের মুখোমুখি হয়, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা জন্য ক্ষতিকর। কর্মসংস্থানের অভাব ও সীমিত সুযোগ–সুবিধার কারণে অনেক যুবক বিদেশে কাজের সন্ধান করছে। বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত যুবদের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে কাজের বাজারে দক্ষতার সঙ্গে মিল না খাওয়ার কারণে তাদের কর্মসংস্থানের তীব্র সংকট হচ্ছে। পুঁজিবাজার, মানবসম্পদ ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জন্য প্রতিযোগিতা কমে যাচ্ছে–অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত বাস্তবায়ন না হলে টেকসই উন্নয়ন ঝুঁকিতে পড়বে।
বেকারত্বের সমস্যার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। নিচে প্রধান কয়েকটি আলোচনা করা হলো:
যদিও বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক দশকে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে, কিন্তু সেই সঙ্গে কর্মসংস্থান তৈরি একই হারে হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, কিছু শিল্প ক্ষেত্রে অটোমেশন ও দক্ষতা–চাহিদার পরিবর্তনের কারণে নতুন শ্রমবাজারের জন্য প্রস্তুতি যথেষ্ট হয়নি। শিক্ষা–দক্ষতার মিল নেই, উচ্চশিক্ষা বা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষিত অনেক যুবক কাজ পাচ্ছেন না । কারণ তাদের দক্ষতা ও শিক্ষা–প্রদান কর্ম–প্রয়োজনে পুরোপুরি মিলছে না। ফলে “চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যার বৃদ্ধিতে কাজের সুযোগ নেই” এমন ধারণা হতাশার জন্ম দিচ্ছে। অফিসিয়াল চাকরিতে প্রবেশ কঠিন, আর অ–নানুষ্ঠানিক খাত যেমন ছোট উদ্যোগ, স্ব–রোজগার মোকাবেলায় রয়েছে নানা ঝামেলা– যেমন ঋণ, অবকাঠামোর অভাব, বাজারসংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ। ফলে কর্মক্ষম যুবকদের জন্য সুষ্ঠু নিয়োগের সুযোগ কমে যাচ্ছে। গ্রামীণ ও নগর অঞ্চলের মধ্যে সুযোগের বৈষম্য রয়েছে। বিশেষ করে গ্রামে বা পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে নতুন উদ্যোগ বা বিনিয়োগ কম হওয়ায় কর্মসংস্থান সৃষ্টি সীমিত।
চাকরির বাজারের তথ্য, স্কিল ট্রেনিং, উদ্যোগ–উৎপাদন চেইন, মাইক্রো ও মাঝারি উদ্যোগ সমপ্রসারণ– এসব ক্ষেত্রে নীতিমালা বা বাস্তবায়ন কাঠামো পর্যাপ্ত গতিতে কাজ করছে না।
সম্ভাব্য রূপরেখা কেমন হওয়া উচিত?
নিচে এমন একটি রূপরেখা উপস্থাপন করা হলো, যেটি আগামী নির্বাচিত সরকার যদি গ্রহণ করে এবং যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে পারে, তাহলে বেকারত্ব হ্রাস ও সুশৃঙ্খল কর্মসংস্থানের দিক থেকে ভালো ফল পাওয়া সম্ভব।
১. ক্যাপাসিটি বিল্ডিং ও দক্ষতা উন্নয়ন : শিক্ষা সিলেবাস ও পঠন পাঠ্যকে বাজার–চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ করতে হবে। তরুণদের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি, ডিজিটাল দক্ষতা, উৎপাদনশীল সেবা–খাত–দক্ষতা বৃদ্ধির মতো উদ্যোগে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। সরাসরি সংযোগ তৈরি করতে হবে প্রতিষ্ঠান, সরকারের স্কিল উন্নয়ন সংস্থা ও বেসরকারি খাতের সঙ্গে, যেন রিসার্চ–ভিত্তিক ও প্র্যাকটিক্যাল ট্রেনিং দেওয়া যায়। নারী ও পিছিয়ে পড়া অঞ্চলের যুবদের জন্য বিশেষ স্কিম চালু করতে হবে যাতে তারা সহজে বাজারে প্রবেশ করতে পারে।
২. উচ্চমূল্য সংযোজিত শিল্প ও সেবা খাত বিস্তার : দেশে যেমন বেসিক রপ্তানি খাত রয়েছে (বস্ত্র, উৎপাদন), সেখান থেকে আরও আধুনিক উচ্চমূল্য সংযোগিত শিল্প ও সেবা–খাত বিকাশের দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
উদ্ভাবন ও স্টার্টআপ–সংস্কৃতিকে উৎসাহ দেওয়া জরুরি। ছোট ও মাঝারি উদ্যোগ বৃদ্ধি পেলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। ডিজিটাল ও প্ল্যাটফর্ম–সেবা, গিগ–ইকোনমি–চলন, রিমোট–ওয়ার্কের সুযোগ বৃদ্ধি দিয়ে কর্মসংস্থান বিস্তার করা সম্ভব।
৩. অঞ্চলভিত্তিক ও গ্রামীণ কর্মসংস্থান সমপ্রসারণ : গ্রামীণ এলাকায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, উৎপাদনশীল কৃষি, ভ্যালু–চেইন, প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প ও স্থানীয় উদ্যোগের বিকাশ ঘটাতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিশেষভাবে পিছিয়ে পড়া জেলায় জেলায় উদ্যোগ সৃষ্টির মাধ্যমে জনশক্তির স্থানীয়ভাবে কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে। সরকারি ইনফ্রাস্ট্রাকচার ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন করার মাধ্যমে প্রান্তিক অঞ্চলে কর্মসংস্থান সুবিধা সৃষ্টি করা যেতে পারে।
৪. চাকরিতে প্রবেশ ও আয় রোজগারের–উপায়ের তথ্যভিত্তিক নীতি : Bangladesh Bureau of Statistics ’র মতো সংস্থা দ্বারা নিয়মিত এবং আধুনিক পদ্ধতিতে কর্মসংস্থান ও বেকারত্ব সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশ করতে হবে, যাতে নীতি নির্ধারণ সহজ হয়। সরকারি–বেসরকারী নিয়োগসূচি, কর্মসংস্থান অফিস–ব্যবস্থা উন্নয়ন করতে হবে, যেন চাকরিপ্রার্থীরা সহজে তথ্য–প্রাপ্তি ও সেবা গ্রহণ করতে পারে।
সামাজিক সুরক্ষা স্কিম ও জীবন জীবিকার উপায় সহায়ক প্রকল্প চালু করতে হবে যা তরুণ, মহিলা, ও পিছিয়ে পড়া অংশের জন্য কার্যকর হবে।
৫. বিনিয়োগ ও উদ্যোগে উৎসাহ–প্রদান : বিদেশি ও দেশি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য কাঠামোগত সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। নতুন শিল্প, রপ্তানিমুখী উদ্যোগ ও সেবা–উপজাত খাত বাড়াতে হবে। কর–উৎসাহ, রপ্তানিতে বিশেষ সুবিধা বা উদ্যোগ–অনুদান দেওয়া যেতে পারে যাতে নতুন কর্মসংস্থান সহজে তৈরি হয়। অংশীদারিত্বমূলক উদ্যোগ (পাইপলাইন–প্রজেক্ট) ও ক্লাস্টার‐ভিত্তিক উৎপাদন কেন্দ্র তৈরি করা যেতে পারে যা স্থানীয় জনশক্তিকে কাজে লাগাবে।
৬. নির্বাহী ও মনিটরিং ব্যবস্থার শক্তিশালীকরণ : বেকারত্ব হ্রাস উদ্যোগগুলোর বাস্তবায়নের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারণ করতে হবে, দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা/ টিম গঠন করতে হবে। নিয়মিত মনিটরিং ও ফলাফল মূল্যায়ন করতে হবে এবং প্রয়োজনে নীতিতে সমন্বয় করতে হবে। স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক সিদ্ধান্ত–প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে যাতে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের (যুব, মহিলা, ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিনিধি) মতামত প্রতিফলিত হয়।
৭. নারী ও তরুণদের অংশগ্রহণ বাড়ানো : নারী ও তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান–যোগ্য স্কিল ও সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে। বিশেষভাবে, মহিলা–শ্রমিক প্রবেশ ও কাজের ক্ষেত্রে বাধা (সনদপ্রদান, সামাজিক সংস্কৃতি, পরিবহন) নিরসন করা জরুরি।
উদ্যোক্তা মহিলা ও তরুণদের জন্য অনুদান ও মাইক্রোফিনান্স সুবিধা দেওয়া যেতে পারে।
মেন্টরিং ও রোল–মডেল স্কিম চালু করা যেতে পারে যাতে তারা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশে উৎসাহ পায়।
বাংলাদেশে বেকারত্ব এখন শুধুই একটি পরিসংখ্যানের চিত্র নয়– এটি সামাজিক স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও যুবশক্তির জীবনে গভীর প্রভাব ফেলা বিষয়। আগামী নির্বাচিত সরকার যদি উপরে উল্লিখিত রূপরেখা অনুসরণ করে সঠিক মনোযোগ, সময় উপযোগী উদ্যোগ এবং সংশ্লিষ্ট সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে, তাহলে বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল এই দেশে কর্মসংস্থান বিস্তৃত ও টেকসইভাবে বৃদ্ধি করতে পারব। কর্মসংস্থান সৃষ্টি মানেই শুধু ‘চাকরি’ নয় – তা মানুষকে আত্মনির্ভরতা দান, সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করা এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে মানবকেন্দ্রিক গতিতে বিকাশ করা।
এই প্রেক্ষাপটে বর্তমান সময়ের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নির্দেশনাকারীদের জন্য অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত – “কাজ সৃষ্টিতে দ্রুততা, দক্ষতায় মান বৃদ্ধি এবং সুযোগের সমতা”। যেখানেই এই তিনটি মাপকাঠি পূরণ হয়, সেখানেই বেকারত্ব হ্রাসের বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে।
লেখক : প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন কায়সার নিলুফার কলেজ











