‘একটা নির্জন রাস্তায়, পাহাড়ি রাস্তায় একটা ফুটপাতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে বলল, ইউ আর ফ্রি নাউ। তখন আমি দেখলাম পাশে একটা বিশাল মাঠ। পরে এটা জানতে পেরেছি এটা শিলং গলফ লিংক নামে একটি জায়গা। প্রাতঃভ্রমণে কিছু লোক হাঁটতে ছিলেন। আমি পরিচয় দিলাম। তারা পুলিশকে কল করল। এরপরে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়।’
এভাবেই বাংলাদেশে টানা দুই মাস আয়নাঘরের বন্দিদশা থেকে ছাড়া পেয়ে ভারতের পুলিশের হাতে বন্দি হওয়ার কথা তুলে ধরেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ। ওই সময়ের স্মৃতিচারণ করে সরকারি কর্মকর্তা থেকে রাজনীতিতে নাম লেখানো এই বিএনপি নেতা বলেন, তারপরে আমার কথাবার্তা শুনে হয়ত তাদের কাছে আমাকে পাগল মনে হয়েছে। তারপরে আমাকে একটা মেন্টাল হসপিটালে নিয়ে যায়। ওখানে ডাক্তারকে আমার পরিচয় দিয়ে অনুরোধ করেছিলাম যে, আমার ফোন নম্বর দিলাম যাতে আমার দেশে যোগাযোগ করে। এরপর শিলং থেকে টেলিফোনে কথা বলার মুহূর্তটির স্মৃতিচারণ করেন তার স্ত্রী হাসিনা আহমদ। বলেন, আমি তখন বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। যখন উনি (সালাহউদ্দিন) আমাকে হ্যালো বলল। সেই মুহূর্তের অনুভূতিটি আমি কাউকে বলে বুঝাতে পারব না। এত জোরে চিৎকার করেছিলাম যে, গাড়ির ড্রাইভার ভয় পেয়ে গিয়েছিল। সে প্রচণ্ড জোরে ব্রেক করে ফেলেছিল।
গত সোমবার বিএনপির এই নেতার গুম হওয়া নিয়ে একটি তথ্যচিত্রে এভাবেই নিরুদ্দেশ থাকার সেই বিভীষিকাময় সময়কার স্মৃতিচারণ করেন এ দম্পতি। এদিন সন্ধ্যা সোয়া ৭টায় ১৭ মিনিটের এ তথ্যচিত্র প্রচার করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের ফেসবুক পেইজে। যাতে সালাহউদ্দিন ও তার স্ত্রীর পাশাপাশি তাদের ছেলে ওই সময়কার দুর্দশা ও নিদারুণ করুণ স্মৃতি তুলে ধরেন। খবর বিডিনিউজের।
এ তথ্যচিত্র তৈরি করা হয়েছে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে, নাম দেওয়া হয়েছে ‘আয়নাঘর ফাইলস’। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে আয়নাঘরে ও অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা নিয়ে এ তথ্যচিত্র নির্মাণ করা হচ্ছে। এটির পঞ্চম পর্বে উঠে এসেছে গুমের শিকার বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমদ ও তার পরিবারের দুঃসহ অভিজ্ঞতার বর্ণনা।
আয়নাঘরে বন্দি থাকার সময় মৃত্যু চিন্তাও পেয়ে বসেছিল সালাহউদ্দিনকে। ভিডিওতে সে কথাও তুলে ধরেন তিনি। তাকে আটকে রাখা সদস্যদের তখন তিনি বলেছিলেন, যদি আমার মৃত্যু হয় লাশটা আমার পরিবারের কাছে দিও। আমি (তাদের) বলতাম, আমার হার্টে স্টেন্টিং আছে, অন্যান্য জটিলতা আছে। এই পরিবেশে ক’দিন টিকব। কত দিন থাকতে পারব জানি না। তবে আমার যদি মৃত্যু হয়, তাহলে আমার লাশটা আমার পরিবারের কাছে দিও। এটা বলার কারণ ছিল তখন শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট সময়ে গুমের সংস্কৃতি চালু হয়ে গিয়েছিল। লাশ পাওয়া যেত না। তারা ক্রসফায়ার দিয়ে লাশ গুম করে ফেলত। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতাম, হে আল্লাহ আমার সন্তান, আমার বংশ পরম্পররা, আমার আত্বীয় স্বজনরা আমার কবর জিয়ারত করতে পারবে না?
রাজধানীর উত্তরা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা বলতে গিয়ে তথ্যচিত্রে সালাহউদ্দিন বলেন, ২০১৫ সাল মার্চের ১০ তারিখ রাত আনুমানিক ৯টা থেকে সাড়ে ৯টা হতে পারে। এই সময়ে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকে অনেক লোক সশস্ত্র অবস্থায় এই বাসায় (উত্তরা) দোতলায়, যেখানে আমি থাকতাম– আমার বন্ধু হাসনাতের বাসায় ফ্ল্যাটে দরজার ভেঙে প্রবেশ করে। আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আমার চোখ, হাত বেঁধে আমাকে নিয়ে।
এরপর তাকে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে রাখা হয়। এরমধ্যে আয়নাঘরের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে তিনি ৬১ দিন ছিলেন বলে তুলে ধরেন। ছোট্ট সেই কুঠুরিতে দিন–রাত প্রায় একই হয়ে পড়া সেই সময়ের বর্ণনা করেন তিনি। শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর দেশে ফিরে আসা সালাহউদ্দিনকে ভিডিওতে সেই ঘরের বর্ণনা দিতে দেখা যায়।
সালাহউদ্দিন বলেন, সেই বাসা (উত্তরা) থেকে ২০/২৫ মিনিটের একটা ড্রাইভ হবে এমনও হতে পারে– তারা ঘুরে ফিরে কোথাও নিয়ে গেছে, যেখানে আমাকে গাড়ি থেকে নামাল। নামিয়ে হেঁটে ভেতরে ঢুকাল সেটা নিচতলা। কোনো সিড়ি বাইতে হয়নি। এটা একটা সেল, যেটা ৫ ফুট বাই ১০ ফুটের বেশি হবে না। সেখানে একটা পানির ট্যাপ ও একটা ছিদ্র আছে– যে নালা দিয়ে পেশাব–পায়খানার সুযোগের জন্য। লাইটটা এখানে ছিল, দরজাটা স্টিলের ছিল। নিচে একটু ফাঁকা ছিল। হালকা খানা–পিনা ঢুকানোর জন্য। আর উপরের দিকে একটু ফাঁকা ছিল। বাইরে সবসময় একটা ফ্যান থাকত।
গুমের পর স্বামীর নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে থানায় অভিযোগ নিয়ে গেলে পুলিশ তা নিতে অস্বীকৃতি জানান বলে ভিডিওতে তুলে ধরেন তার স্ত্রী হাসিনা আহমদ। তিনি বলেন, থানা বলল তারা জিডি নিতে পারবে না কোনো রিজনেবল গ্রাউন্ড ছাড়া। আমি বললাম, আমি উনার স্ত্রী পাগলের মতো এখানে–ওখানে ঘুরতেছি, আমার স্বামীর সন্ধানে। আর উনারা আমাকে সাহায্য করবে না। বাধ্য হয়ে পরে হাই কোর্টের শরাণাপন্ন হই। খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং মওদুদ আহমেদ সাহেব তারা এই রিটের জন্য আমার পক্ষে আদালতে দাঁড়িয়েছেন। দীর্ঘদিন সংগ্রামের পরে আদালত অবশেষ একটি রায় ঘোষণা করেন যে, সরকারকে নির্দেশ দেন আমার স্বামীকে যেন ওনারা খুঁজে বের করে দেন। এটুকুই আমার প্রাপ্তি ছিল। কিন্তু সরকারের কোনো মহল থেকে কোনো ধরনের সহযোগিতা পাইনি।
হাসিনা আহমদ বলেন, আমি সবার দুয়ারে গেছি আমার স্বামীকে খুঁজে বের করে দেওয়ার জন্য। আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে গিয়েছিলাম কিন্তু আমাকে গেট থেকেই বিদায় করে দেয়া হয়েছিল।












